বাইশ বছর ধরে (Man is made by his belief. . .)

রোম্যান্টিক প্রেমের নিদর্শন বলতেই চোখে ভেসে ওঠে সাদা ধবধবে তাজমহল। কিংবা রূপোলী পর্দার নামকরা নায়কের চোখ কুঁচকে দু’পাশে হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো ছবি। রোমান্টিকতায় যেন উপরমহলের কিছু নামকরা মানুষেরই অধিকার। সাধারণ মানুষের কোন অধিকার নেই।

শুধু রোমান্টিকতা কেন সাধারণ মানুষের তো অন্যান্য অনেক কিছুর উপরেও অধিকার নেই। অধিকার নেই ভালো স্বাস্থ্য ব্যাবস্থায়, ভালো শিক্ষা ব্যাবস্থায়, ভালো যোগাযোগ ব্যাবস্থায়, ভালো রাস্তা ঘাটে। সব ভালো তোলা থাক উপর মহলের জন্যে।

সব মন্দ নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের দিনরাত্রি কাটে। দু’মুঠো অন্নের ব্যবস্থা করতে করতেই সূর্য অস্তরাগী। সাধারণ মানুষের পেটের একটু উপরেই যে হৃদয় আছে তার খবর সে নিজেও বোধহয় জানে না।

কিন্তু, সেই হৃদয় যেদিন জাগে সেদিন ভালোবাসার মানুষটির জন্যে পথের বাধা দূর করতে পাহাড় কেটে রাস্তা বানায়। অতি সাধারণ সেই মানুষটি অতি অসাধারণ হয়ে ওঠে। কোদাল বেলচা নিয়ে পৌঁছে যায় পাহাড় কাটতে। একদা যে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে তার প্রেয়সী আহত হয়েছিল সেই পাহাড়কে কেটে ফেলতে এই অতি সাধারণ মানুষটি হয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পাহাড়ের পাথর যত কঠিন শতগুণ কঠিন সেই সাধারণ মানুষটির প্রতিজ্ঞা।

দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সেই মানুষটিকে সেদিন সবাই ‘পাগল’ বলেছিল। ওর কাজকে বলেছিল ‘অহেতুক কাজ’। কিন্তু, মানুষের কথা কানে না শুনে সেই সাধারণ মানুষটি ব্যস্ত ছিল পাহাড়ের কাঠিন্যর গর্বকে মলিন করার কাজে। পড়াশোনা না জানা সেই মানুষটির অবচেতন মনের কোন এক কোণায় হয়তো গীতার সেই বানী নিহিত ছিল, তাই মানুষটি ফলের আশা না করে মত্ত ছিল পাহাড় কাটার কাজে।

কিংবা, পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে দাগ কেটে যেতে চেয়েছিল মানুষটি, তাই দীর্ঘ বাইশ বছর ধরে কঠিন পাহাড়ের পাথরের বুকে ছেনি হাতুরি দিয়ে আঁচড় কেটে চলেছিল।

বিহারের গলুর গ্রামে গরমের সময় কতো গরম হয় সে ওখানে না গেলে তো বোঝা যাবে না, কিন্তু তাপমাত্রা শুনলে হয়তো কিছু আন্দাজ করা যাবে। তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। কাঠ ফাটা প্রখর রোদ্র আর রুক্ষ গরম বাতাস বয়ে চলে এখানে। সেই গরমে কোদাল বেলচা দিয়ে পাহাড়ের পাথর কাটার মতো পরিশ্রম কোন সাধারণ মানুষ মনে হয় করতে পারবে না। তাও আবার সেই কাজ যে কাজকে আপাতদৃষ্টিতে অহেতুক, অর্থহীন বলে মনে হয়। যে কাজের কোন নিকট ভবিষ্যৎ নেই।

কিন্তু সেই অতি সাধারণ মানুষটি শুধু তার প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়। হয়তো বা প্রতিদিন সকাল হত তাঁর এই ভেবে যে – আজ দু’ইঞ্চি পাথর কাটব। পৃথিবীতে হয়তো ইতিহাস তারাই তৈরি করে যারা পাগলামি করার সাহস রাখে বা সেই পাগলামি নিয়ে বাঁচতে পারে।

দীর্ঘ বাইশ বছর ধরে সেই অতি সাধারণ মানুষটি পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করে দিল। এতো প্রশস্ত রাস্তা যে অনায়াসে বড় বড় গাড়ি চলে যায়। এই রাস্তা কাটার ফলে আত্রি আর ভাজিরগঞ্জ সাব ডিভিশনের মধ্যের দূরত্ব সত্তর কিলোমিটার থেকে কমে গিয়ে মাত্র আট কিলোমিটার হয়ে গেছে।

সাজাহানের তাজমহল তৈরি করতে হাজার হাজার মানুষ দিনরাত কাজ করেছে। শুধু একাই পাহাড় কেটে দিল এই মানুষটি, কিন্তু যার জন্যে এতো কিছু – সেই ফাল্গুনী দেবী মারা গেলেন চিকিৎসার অভাবে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ সামান্য চিকিৎসা করানোরও তো অধিকার নেই সাধারণ মানুষের। স্বামীর এই উপহারটি দেখে যেতে পারলেন না।

সেই অতি সাধারণ দশরথ মাঝির নামে আজ সেই রাস্তার নাম। আজ সেই পাগল দশরথ মাঝির নিজের হাতে বানানো রাস্তা দিয়ে পার হয় হাজার মানুষ, এই ব্যস্ত পৃথিবীর কাজী মানুষের সময় বাঁচে। মানুষটি একটি শর্ট কার্ট রাস্তা বানাতে নিজের জীবনের বাইশ বছর দিয়ে দিল। লোকে বলে সাফল্যের কোন শর্ট কার্ট রাস্তা নেই। সাফল্যের এই শর্ট কার্ট রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দীর্ঘ বাইশ বছর সময় লেগেছে।

এই সাধারণ মানুষটির অসাধারণ কৃতিত্ব নিয়ে, তাঁর অতি সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে এক অসাধারণ সিনেমা কবে হবে আমাদের দেশে? শোনা যায় দূরদর্শন ডকুমেন্টারি বানাবে বলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে গল্প কেনে, কিন্তু এক টাকাও দশরথ মাঝি হাতে পায় নি।

আমরা বড়ই সাধারণ, অতি সাধারণ ভাবে অন্যের কাছ থেকে স্বপ্ন ধার করে বাঁচি। সেই আমরা দশরথ মাঝির মতো সাধারণ মানুষের এই অসাধারণ কাজে প্রেরণা পাই। প্রেরণা পাই স্বপ্নের পিছে ছুটে চলার, প্রেরণা পাই কাজ করার, প্রেরণা পাই অসম্ভব কে সম্ভব করার। কর্মান্যে ভাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন। মা কর্মফলা হেতু ভুরমাত্যে সঙ্গস্তভা অকর্মানি।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Inspirational and tagged , , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান