October 2012, Copenhagen, Denmark
কোপেনহেগেনে পৌঁছে প্রথমেই টুরিস্ট অফিসে গিয়ে ওখানের ম্যাপ নিয়ে শুরু হল কোপেনহেগেন দর্শন।
কোপেনহেগেনের বেশীরভাগ পুরুষ মহিলাই সাইকেল চালায়। এই কনকনে ঠাণ্ডায় হাত বের করে সাইকেল চালানো সহজ কাজ নয়।
এখন এখানে হ্যালইনের মরশুম চলছে। এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে কোপেনহেগেন সেন্ট্রাল চলে এলাম, ষ্টেশনের বাইরেই ঠিক উলটো দিকে তিভলি গার্ডেন।
এই গার্ডেনে এই সময় হাজার হাজার কুমড়ো সাজিয়ে রাখে, কুমড়োর ভুত সাজায়, কুমড়ো ঝুলিয়ে রাস্তার দু’ধার সাজায়। তিভলি গার্ডেন শুনেছি রাতে আলো দিয়ে সাজায় ভাল, নানান ভুত প্রেতের পোশাক পরে ভুত সেজে ঘুরে বেরায় অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা। এখানে এখন খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে তাই আমরা ভাবলাম আগে অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান গুলো ঘুরে দেখে নি, পরে এসে তো এখান থেকেই ট্রেন ধরতে হবে তখন রাতে তিভলি গার্ডেন দেখে নিয়েই ট্রেনে চেপে পরব।
ষ্টেশন থেকে বেড়িয়ে শহরের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম। কোপেনহেগেন বেশ ছোট শহর, হেঁটেই ঘুরে নেওয়া যায়।
রঙিন বাড়ি, ক্যানাল সব মিলিয়ে কোপেনহেগেন বেশ সুন্দর শহর, পুরনো দিনের বড় বড় সব স্থ্যাপত্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পুরনো শহর, স্পাইরাল টাওয়ার দেখে ম্যাপ দেখে এগিয়ে চললাম, আমাদের উদ্দ্যেশ্য ‘নাইহাভেন’, ‘নাইহাভেন’ মানে নতুন বন্দর।
এখানে অনেক ছোট বড় পালতোলা নৌকো দাঁড়িয়ে। লোকজন খুব কম, এই ক্যানাল ধরে নৌকো ভ্রমণের বন্দোবস্তও আছে কিছু ইউরোর বিনিময়ে কিন্তু এই জমাট ঠাণ্ডায় যে কয়েকজন চোখে পরছে তাঁদের খুব একটা নৌকো ভ্রমণের উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না।
স্ক্যান্ড্যানাভিয়ায় অক্টোবরের এই সময়ে গাছের পাতার রঙ্গে যেন আগুন লেগেছে, একটাও গাছের পাতাও সবুজ নয়, পাতা ঝরার রঙ যে এত স্বপ্নিল সুন্দর হতে পারে ভাবিনি এবং দেখিনি কখনও। এখানের প্রকৃতি মারকাটারি রঙ্গে সেজেছে বছরের এই সময়ে। শীত শুরুর সময় আর গাছের হলুদ লাল পাতা বাতাসের সঙ্গে ঝরে পড়া – কেমন এক অদ্ভুত মনখারাপ করায়। কেমন যেন এক নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই।
পুরনো শহরের মাঝে ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম লেকের কাছে। এখানের এই লেকের কাছে বড় পার্কে লোকেরা দৌড়োয়, বসে। পার্ক ও সেজেছে হলুদ কমলা রঙের গাছের পাতায়।
আমাদের উদ্দ্যেশ্য লিটিল মারমেড।
লিটিল মারমেড সম্বন্ধে শুনেছি অনেক এখানে আসার আগে, দেখে কিন্তু বেশ হতাশ হলাম। বন্দরের সীমানায় সমুদ্রের তীরে ছোটো এক মৎস্যকন্যার মূর্তি। তাকে ঘিরে প্রচুর টুরিস্ট।
ক্ষণে ক্ষণে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠছে। লিটিল মারমেডের সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তোলার লাইন লেগেছে ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সমুদ্রের জলো হাওয়ায় ঠাণ্ডা আরও জাঁকিয়ে পড়েছে। আমাদের ফিরে আসতে হবে, ফেরার পথে রাজপ্রাসাদ দেখে নিলাম, বিশাল রাজপ্রাসাদের চত্বরে লাল পোশাকের প্রহরী সতর্ক পাহারায়।
এই সময়ে প্রহরী বদলে যায়, নতুন প্রহরী এসে পুরনোর জায়গা নেয় কুচকাওয়াজের সঙ্গে, ধূসর সন্ধ্যায় বিশাল রাজপ্রাসাদের চত্বরে প্রহরী বদলানো দেখতে দেখতে যেন চলে গিয়েছি ইতিহাসের পাতায়। ইতিহাস যেন থমকে আছে এখানে, নাকি এরা জানে ইতিহাসকে জীবিত রাখতে নতুন প্রজন্মের জন্যে যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইতিহাসের একটু ছোঁয়া পায়, একটু আঁচ পায়। কে জানে, তবে এই অনুভুতি অদ্ভুত। হয়তো ভবিষ্যৎ জীবনের কোন এক পড়ন্ত বিকেলে আজকের এই অনুভুতি মনে পড়বে, রোমাঞ্চ জাগবে।
এবার তিভলি গার্ডেনের উদ্দ্যেশ্যে হাঁটা, ফেরার পথে রাস্তা গেল ঘুলিয়ে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম।
সারা শহরে আলো জ্বলে উঠেছে, তিভলিতে ঢোকার টিকিট কাটার লম্বা লাইন। আমাদের আর প্রায় চার ঘণ্টা সময় আছে এখানে, তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে নিয়ে তিভলি গার্ডেনে ঢুকলাম। আগেই বলেছি এই হ্যালইনের সময় এখানে প্রচুর কুমড়ো দিয়ে সাজায়, চারিদিকে কুমড়ো মানুষ, কুইন্টেল কুইণ্টেল কুমড়ো, খড় দিয়ে সাজানো ভুতুরে বাড়ি, ভুতুরে পোশাক পরে সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, আলো আধারিতে এক অদ্ভুত ভুতুরে পরিবেশ।
রাত দশটায় আমাদের স্টকহোম যাওয়ার ট্রেন। এবার ট্রেনের অপেক্ষা, সারা রাতের যাত্রা।