June 2012, Granada, Spain
যখন lion কোর্টে পৌঁছই জুনের দুরন্ত রোদ্দুর মাথায় নিয়ে আলহাম্ব্রার মুরিস সাম্রাজ্যের বিশাল রাজপ্রাসাদের পাহাড়ি পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে তখন একটু থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হয় বই কি, শুধু কি ক্লান্ত হয়ে জিরিয়ে নেওয়া? তা নয়, lion কোর্টে-এর সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে চমক লেগে থমকে যাওয়াও বটে। অদ্ভুত সৌন্দর্য এই lion কোর্টের, lion কোর্ট রাজপ্রাসাদের এক অংশ। এখানের প্রতিটি দেওয়ালে কারুকার্য, প্রাসাদের থামে সূক্ষ্ম কাজ। জুনের দুরন্ত গরম আর রোদ্দুর এখানে অনুভূত হয় না, কেমন এক ঠাণ্ডা পরশ এখানের এই অংশে।
এই lion কোর্ট নাকি শতাব্দী কাল ধরে অবহেলিত ছিল, কেউ নজর দেয় নি এই lion কোর্টের দিকে। শুধু lion কোর্ট কেন ১৮ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত এই রুপকথার রাজপ্রাসাদ আলহাব্রা শুধু স্প্যানিশ চোর, ভিখারি আর ডাকাতদের আস্থানা ছিল, বাদুর ঝুলত রাজপ্রাসাদের আনাচে কানাচে। আলহাম্ব্রার অনেক সৌন্দর্য শতাব্দী ধরে চোর ডাকাতদের হাতে নষ্ট হয়ে গেছে। তারপর ১৮০২ থেকে ১৮১২ পর্যন্ত নেপলিয়ানের সৈন্যদের আস্থানা হল এই আলহাব্রার রাজপ্রাসাদ। তাঁরা সৌন্দর্য বজায় রাখার চেয়ে ব্যস্ত ছিল লুটতরাজে আর ধ্বংসে।
এই স্বপ্নিল রাজপ্রাসাদের অবহেলা বজায় রইল ১৮৭০ পর্যন্ত। যে কোনো দেশের সম্পদ এবং সৌন্দর্যের প্রশংসা কিন্তু ভ্রমন পিপাসু বিদেশীরাই করে। ভ্রমন পিপাসু বিদেশিরাই প্রকৃত সৌন্দর্যে অবিভূত হয় আর তার প্রচারও করে। তেমনি এক বিদেশি আমেরিকান ভ্রমণকারী এলেন স্পেন, এলেন গ্রানাডা দেখলেন আলহাব্রা। তিনি আলহাম্ব্রার সৌন্দর্যে প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হলেন। গ্রানাডার রুক্ষতার মাঝে যেন এক অদ্ভুত মায়াপুরী এই রাজপ্রাসাদ।
তিনি থাকতে চাইলেন এই রাজপ্রাসাদের ঘরে। কিন্তু জঙ্গলে ঘেরা অবহেলিত প্রাসাদে থাকার সম্মতি পাওয়া এক বিদেশির পক্ষে বেশ কঠিন, কিন্তু গ্রানাডার আর্ক বিশপ সাহায্য করলেন এবং সঙ্গে একজন গাইড দিলেন।
আলহাম্ব্রার সৌন্দর্য বর্ণিত হল তাঁর লেখনিতে, আর তাঁর আঁকা ছোট ছোট স্কেচের মধ্যে। তাঁর লেখা বই Tales of the Alhambra প্রকাশিত হল দেশে বিদেশে এবং তা অনেক কবি সাহিত্যিকদের দৃষ্টি কেড়েছে।
ভ্রমণকারীরাই ধিরে ধিরে আলহাম্ব্রার পুরনো মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছে।
হ্যাঁ, বলছিলাম lion কোর্টের কথা। lion কোর্ট চত্বরের মাঝে আছে এক ফোয়ারা আর তাকে ঘিরে আছে বারোটা সিংহ। প্রতিটি সিংহের মুখ দিয়ে জল পরে এক এক ঘণ্টা অন্তর, মাঝে এই ফোয়ারা আর তাঁর চারপাশে লম্বা বারান্দা। বারান্দার থামে ও দেওয়ালে কারুকার্য, জ্যামিতিক নক্সা কাটা।
এই lion কোর্টের সিংহদের মেরামত চলছিল তাই সেই ফোয়ারা থেকে জল পড়া দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয় নি। কিন্তু লম্বা টানা বারান্দায় ও তার ছাদের কারুকার্য চোখ ধাঁধায়, টুরিস্টদের নানান ধরণের ক্যামেরা ঝলসে ওঠে। টানা লম্বা বারান্দার সারি সারি থাম রোদে ছায়া ফেলেছে, এক নস্টালজিক ছবি তৈরি হয়েছে।
ইউরোপে মুরিস সাম্রাজ্যের নিদর্শন এই আলহাম্ব্রা, তাই এখানের স্থাপত্য অন্যরকম। শীতপ্রধান ইউরোপের অন্যান্য জায়গার ক্যাসল গুলোর ভেতরে কেমন যেন আলো হাওয়ার অভাব, অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে, ঘরগুলোও ছোট ছোট কিন্তু আলহাম্ব্রার প্রাসাদের প্রতিটি ঘরে প্রচুর আলো প্রচুর হাওয়া, প্রতিটি ঘর অনেক বড়, প্রতিটি ঘর গিয়ে শেষ হয়েছে বাগানে। আর বাগানে জল, ফোয়ারা, ফুল, এক অদ্ভুত সুন্দর খোলামেলা পরিবেশ।
এই lion কোর্ট মুরিসদের স্বর্গীয় বাগান, বলা যেতে পারে স্বর্গীয় বাগানের পার্থিব রূপ। lion কোর্টের চারিপাশের ঘর গুলো ছিল সুলতানের হারেম।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে এই lion fountain প্রায় একহাজার বছরের পুরনো, এবং এটা সুলতান মোহাম্মদ পাঁচ এর সময়ের, তৈরি হয়েছিল ১৩৫৪ থেকে ১৩৫৯ র মধ্যে। এই lion কোর্ট শাদা পাথরের শুধু যে একটা ফোয়ারা তা নয়, এই ফোয়ারা সেই সময়ের ইসলামিক সূক্ষ্ম স্থ্যাপত্যের নিদর্শন।
তাঁদের জ্যামিতিক জ্ঞানের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এখানের দেওয়ালের কারুকার্যে, প্রতিটি টাইলসের সূক্ষ্ম জ্যামিতিক চিত্রে।
আলহাম্ব্রা শুধু যে মুরিস স্থাপত্যের নিদর্শন তা নয় আলহাম্ব্রা মানুষের স্থাপত্য আর প্রকৃতির সমন্বয়। এই প্রকৃতিকে স্থ্যাপত্যের সাহায্যে আরও সুন্দর করতে পারার নিদর্শন এই আলহাম্ব্রা। আলহাম্ব্রাকে অনেক কবি পান্না আর মুক্তোর নেকলেস বলে বর্ণনা করেছেন, কারণ আলহাম্ব্রার চারিদিক জুড়ে সবুজ বাগান আর সারি সারি গাছ।
আলহাম্ব্রা রাজপ্রাসাদের কাজ সুরু হয়েছিল ১৩ শতকে কিন্তু এই রাজপ্রাসাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসকের হাতে তৈরি হয়েছে, হয়তো উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর বুকে এক স্বর্গ তৈরি করা। ফোয়ারা, জল, ফল, ফুল, সমস্ত কিছু দিয়ে সাজানো এই রাজপ্রাসাদের ঘর গুলোর উঠোন।
আলহাম্ব্রা রাজপ্রাসাদের তিনটে অংশ। একদিকে রাজকীয় প্রাসাদ, রাজকীয় প্রাসাদের আবার তিন ভাগ- এক দিকে হারেম যার মাঝে lion কোর্ট আর এক দিকে meuxuar আর serallo। প্রতিটি অংশ থেকেই বাগানে যাওয়া যায়। বাগানে সারি সারি কমলালেবুর গাছে কমলালেবু ফলে রয়েছে। সারি সারি গোলাপের ঝারে নানান রঙের গোলাপ, ফোয়ারার জলের বয়ে চলার মৃদু কলকল শব্দ। এক অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ মন জুরিয়ে দেয়। ইতিহাস থমকে আছে এখানে, মনে হচ্ছে এই তো কয়েক দিন আগেই ছিল রাজা রানীর যুগ। নিজেকে অনেকটা ঐতিহাসিক চরিত্র বলে মনে হচ্ছে।
এখন এই রাজপ্রাসাদ এবং তাঁর বাগান অতিব যত্নে সাজানো। সারা বছর প্রচুর ভ্রমণকারী আসে এখানে পৃথিবীর সারা কোন থেকে।
রাজপাসাদের ঢোকার টিকিট কাটতে মানুষের লম্বা সারি। অনেকে ভোর চারটে থেকে লাইনে দাঁড়ানো, তবে এখন ইন্টারনেটের যুগে অনেক কিছুই অনেক সহজ, আমরা অনেক আগেই টিকিট কেটে নিয়েছিলাম ইন্টারনেটে তাই আমাদের রাজপ্রাসাদের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয় নি। আমরা সকালেই ঢুকে পড়েছিলাম কারণ আমরা জেনে নিয়েছিলাম যে এই রাজপ্রাসাদ পুরো ভাল করে দেখতে প্রায় সারা দিন লেগে যায়।
সারাদিন রাজপ্রাসাদের আনাচে কানাচে এ মহল ও মহল ঘুরে ক্লান্ত পায়ে যখন ফিরে আসছি আলহাম্ব্রা থেকে, মন কিন্তু থেকে যেতে চাইছে আরও কিছুক্ষণ, কারণ তখন পাহাড়ের উপরে এই রাজপ্রাসাদের বুকে সূর্য অস্তগামী, তাঁর লাল কমলা রঙের আলো ছড়িয়ে পরেছে সারা রাজপ্রাসাদ জুড়ে আর কেমন যেন এক অদ্ভুত উদাসীন রোম্যান্টিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু ফিরে আসতে হবে।
আলহাম্ব্রা এখনও প্রতিদিন হাজার মানুষ স্বাগত জানায়। এখনও তাঁর বুকে সূর্যাস্তের লাল রঙ লুটিয়ে পরে সাক্ষী থাকে হাজার মানুষ।