মাঝে মাঝেই দেখি বিদেশী মিডিয়া তৃতীয় বিশ্বের দেশের মানুষের জীবন যাপনের উপরে ডকুমেন্টারি তৈরি করে, তৃতীয় বিশ্বের মানুষের আর্থিক অবস্থা দেখিয়ে ঐ মিডিয়া গুলোর যেন অনেকটা আত্ম তৃপ্তি হয়।
তাই মনে হয়, কেউ কে এফ সি তে বসে চিকেন ভাজা খাচ্ছে না, বলে এটা ভাবার কোন কারণ নেই, যে উন্নতিশীল দেশ বা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ চিকেন খেতে পাচ্ছে না। তৃতীয় বিশ্বের যে কোন গ্রামে গেলেই চোখে পড়ে – উঠোন ভরা মুরগি, মাঠ ভরা ধান – সারা বছরের খাদ্যের যোগান, বাড়ীর পাশে তাঁত বোনার মেশিন, ছাগল, গরু, হাঁস, সবজি সবই ঘরে। সাধারণ জীবন যাপনের জন্যে কোন কর্পোরেট বিজনেস হাউসের উপরে নির্ভর করতে হয় না – তবুও কেন পৃথিবীর আশি শতাংশ মানুষকে, প্রচুর দেশকে আজও ‘গরীব’ আখ্যা দেওয়া হয়।
কারণ কি? কারনটা অনেকটাই আইনি, লিগ্যাল ডকুমেন্টেশনের ব্যপার। পৃথিবীর আশি শতাংশ মানুষ যারা আজও পরিচয়হীন, কোন পরিচয়পত্র নেই, অথচ তাদের থাকার জন্যে বাড়ী তো আছে, ধান তো আছে, গবাদি পশু আছে, সোনা আছে, টাকা আছে, অথচ ওদের সম্পদের কোন আইনি ডকুমেন্ট নেই – যা কিনা পশ্চিমের দেশ কখনোই কল্পনা করতে পারে না।
ওদের প্রতিটি জিনিসের একটা লিগ্যাল ডকুমেন্ট থাকে, ওদের কাছে দশটা গরু, দশটা ছাগল থাকলেও তার সঠিক ডকুমেন্টেশন থাকে, আইডেন্টিফিকেশন থাকে, ভ্যালুয়েশন থাকে। এমনকি, গরু, ছাগল বিক্রি করার সময়েও ওরা পশুর ডকুমেন্ট বদল করে, মালিকানা বদল করে, সব কিছুর এক হিসাব থাকে। পশ্চিমের দেশে, মানুষ কোনদিন ফার্মে না গিয়েও, পশু গুলোকে চোখে না দেখেও, গবাদি পশু কেনাবেচা করতে পারে – শুধু মাত্র ডকুমেন্ট দিয়ে।
আমাদের মতো দেশে, যে কোন ছোট খাটো ব্যবসা হোক বা সে চাষির কাছে গরু ছাগলের হিসাবই হোক, কিংবা জায়গা জমি, বাড়ী – সব কিছু মুখে মুখে কেনা বেচা হয়। এক সমান্তরাল অর্থনীতি চলে – বিশ্বের মানুষের কাছে যার কোন হিসাব নেই, গ্লোবালাইজেশনের সিস্টেমের বাইরে, আইনের বাইরের এক অর্থনীতি। অনেকটা ঠিক ফল্গু নদীর চোরা স্রোতের মত – স্রোত বয়ে চলেছে, অথচ কেউই দেখতে পারছে না। আর সেই চোরা স্রোতের যে কতো সম্মিলিত শক্তি হতে পারে তা কেউই হয়তো কল্পনাই করতে পারে না।
কিছুদিন আগেই সারা পৃথিবী দেখলো, ভারতবর্ষ এক রাতে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বন্ধ করে দিয়েছিল, আর সারা ভারতবর্ষের মানুষই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল – অনেক পর্যায়ে নিন্দা ও প্রশংসার মধ্যে, মাত্র দুই মাসের মধ্যেই ব্যাঙ্কে ২১৭ বিলিয়ন ডলার জমা পড়ে গিয়েছিল। ঐ টাকা গুলো কাদের কাছে ছিল – ভারতবর্ষের অতি সাধারণ মানুষের কাছেই তো ছিল ঐ টাকা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় হিসাব কষে দেখা গেছে, বিশ্বের আশি শতাংশ মানুষ যারা ঐ গ্লোবালাইজেশন সিস্টেমের বাইরে রয়ে গেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের কাছেই রয়ে গেছে। তাদের নিজস্ব অর্থনীতি আছে, ছোট ব্যবসা, স্কুল, হাসপাতাল সবই আছে। বলা হয়, উন্নতিশীল দেশেই প্রতিটি স্তরে সবচেয়ে বেশী ওন্তারপ্রুনার দেখা যায়। আর সেই আশি শতাংশের কাছে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ আছে, যার কোন হিসাব নেই, আইনি ডকুমেন্ট নেই।
একটা দেশ কখনো গরীব বা ধনী হতে পারে না – দেশের মানুষ ঐ দেশকে গরীব কিংবা ধনী করে। গত একশো বছরের ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যায়, আমেরিকা হোক বা সুইজারল্যান্ড – এক সময় খুবই গরীব ছিল। ওদের অর্থনীতি ছিল খুবই দুর্বল। দেখা গেছে, সব স্তরে লিগ্যাল রিফর্মই আমেরিকা বা সুইজারল্যান্ডকে ধনী দেশে পরিণত করেছিল। গণতন্ত্র, লিগ্যাল রিফর্ম ও অর্থনীতির যে সমীকরণটি আছে, তার সমাধানেই দেশের উন্নতি হয়।
দরজা বন্ধ করে দাও – ঐ দিকে অনেক মানুষের ভিড়। তৃতীয় বিশ্বের মানুষ, ডেভেলাপিং কান্ট্রির মানুষ, ওরা যাতে ঢুকতে না পারে, আমরা প্রথম বিশ্ব, আমরা উন্নত, ধনী। হয়তো, এই ধরণের ভাবনাই এক সময় গ্লোবালাইজেশনের সিস্টেমকে ভেঙ্গে দিতে পারে। গ্লোবালাইজেশনের খেলায় ঐ আশি শতাংশ মানুষকে বাদ দিলে যে খেলার নিয়মই বদলে যেতে পারে।