ইউরোপ ভ্রমণের ছবির সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ির ছবি গুলো যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে – সে স্পেনের শহর সেভিল থেকে নিয়ে প্রাগ, ভিয়েনা, সেলজবার্গ, রোম – যেখানেই গেছি ঘোড়ার গাড়ির দেখা পেয়েছি – মানুষের সঙ্গে ঘোড়ার বন্ধুত্বের সেই ঐতিহাসিক চিরন্তন বন্ধনটি ইউরোপের ঐতিহাসিক শহর কেন্দ্রের পথে পথে আজও দেখা যায়।
এখানে আজও ঘোড়ার গাড়ির চালক ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লে, ঘোড়া তার খুর ঠুকে দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে গলার ঘণ্টি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে – কোথাও ভুল হয়ে গেল না তো?
আবার দেখেছি, সেভিল শহরে সন্ধ্যা নামার আগে ঘোড়ার গাড়ির মালিক দিনের শেষ সওয়ারির খোঁজে প্রায় প্রতিটি টুরিস্টকে জিজ্ঞেস করে – ওলা – মানে হ্যালো?
এখানে দেখেছি মানুষের সঙ্গে ঘোড়া গুলোর এক অদ্ভুত বন্ধন – কে কার জন্যে বোঝা মুশকিল – ভিয়েনা শহরে, সেদিন যখন আকাশ কালো করে মেঘ করেছিল, থেকে থেকে বৃষ্টি নামছিল – ঘোড়া গুলোকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেওয়ার জন্যে ঘোড়ার গাড়ির মালিক গুলোর তৎপরতা দেখেছিলাম – এক নীরব ভালোবাসার সাক্ষী হয়েছিলাম। মানুষের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়াগুলো যেন মানুষের জীবনের সমস্ত উত্থান পতনের এক নীরব সাক্ষী হয়ে রয়ে যায়।
শুধু কি মানুষ? শুনেছি, সিন্ধু সভ্যতার পতনের মূলেও ছিল ঘোড়া ব্যবহার করতে না পারা – অবশ্য অনেক ইতিহাসবিদরা বলে, সিন্ধু সভ্যতায় আজকের দিনের ঘোড়া ছিল না বটে, কিন্তু ঘোড়া ছিল – অন্য ধরণের ঘোড়া, আজকের ঘোড়ার পূর্ব পুরুষরা ছিল।
যাইহোক, এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইউরোপের গ্রামের দিকে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার হোতো, কিন্তু, গত এই দুই শতাব্দী ধরে পৃথিবী এতো দ্রুত উন্নত হয়ে চলেছে, যে ঘোড়ার গাড়ি গুলো রাতারাতি ইউরোপের বড় শহরের রাস্তা গুলো থেকে উধাও হয়ে যেতে শুরু করেছিল – এমনকি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নতুন সদস্য রোমানিয়ার শহর গুলোয় এই কিছুদিন আগেও দৈনন্দিন কাজে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার হোতো।
কিন্তু, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিতে গিয়ে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিয়ম মেনে চলার জন্যে রোমানিয়াকে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হয়েছিল – এর ফল হয়েছিল – প্রচুর বেকার ঘোড়া। ফলে – রোমানিয়ার পথে ঘাটে, পার্কে মালিক বিহীন ঘোড়া দেখা যেতে শুরু করল – কেউই ঘোড়ার মালিকানা দাবী করত না – প্রচুর ঘোড়া অনাহারে হার জিরজিরে হয়ে মৃত্যুর জন্যে দিন গুনছিল – আবার প্রচুর ঘোড়ার শেষ ঠিকানা হয়েছিল স্লোটার হাউস। সেই সময় রোমানিয়া, বিফের নাম করে সমস্ত ইউরোপকে ঘোড়ার মাংস সরবরাহ করতেও দ্বিধা করে নি – ইউরোপের ইতিহাসে সে ছিল এক বিশাল খাদ্য কেলেঙ্কারি।
যাইহোক, ইউরোপের ঐতিহাসিক পথে আজ যে ঘোড়া গুলোকে দেখা যায়, তারা রীতিমত স্বাস্থ্যবান, তেজি। চালকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে – আর ঘোড়ার গাড়ি গুলো ইউরোপের ঐতিহাসিক শহর কেন্দ্র গুলোর ঐতিহাসিকতার সঙ্গে মানানসই এক রোম্যান্টিক ছবি হয়ে থাকে।