প্যারিসের কণকণে জমাট ঠাণ্ডায়, সিঁড়ির মুখে ঘাড় নিচু করে বসে, এক মনে লোকটি বাদ্যযন্ত্রটি বাজিয়ে চলেছিল – তার সামনে রাখা ছোট্ট সুটকেসে, কে কত ইউরো ফেলছে, সে দিকে তার বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তার সম্পূর্ণ মন ছিল ঐ যন্ত্রে, তার আঙুল ও অসংখ্য তারের ঝংকারে তৈরি হচ্ছিল সুর, আর সেই সুরের যাদু, সেদিনের সেই ধূসর বৃষ্টি ভেজা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছিল – এক ম্যাজিক তৈরি করছিল।
সুর, রূপকথা, গল্প, সাহিত্য, ছবি, রং-তুলি, প্রাচীন স্থাপত্য, গলি – সব নিয়ে ইউরোপ এক রোম্যান্টিক ছবি – আর সেই রোম্যান্টিক রুপকথাকে বাস্তবে এনে দেয় এখানের পথের সঙ্গীত শিল্পীরা।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সেই লোকটিকে ঘিরে এক জটলা তৈরি হয়েছিল, অনেকেই ভিড় করে এই ঠাণ্ডাতে দাঁড়িয়ে, অসংখ্য তারের মধ্যে লোকটির দ্রুত আঙুল চালানো দেখছিল, অদ্ভুত সেই বাজনা বাজানোর ধরণ, সবাই ক্ষণিক দাঁড়িয়ে লোকটির বাজানো সুর শুনছিল, বিশেষ করে জাপানি টুরিস্ট ও তাদের বাচ্চাদের মধ্যে প্রচুর কৌতূহল ছিল।
মানুষের সভ্যতার সঙ্গে এই বাদ্যযন্ত্রের যোগাযোগ নাকি বহু বছরের পুরনো – অনুমান করা হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন ইজিপ্ট ও মেসোপটেমিয়ার পাথুরে ছবিতেও এই বাদ্যযন্ত্র ‘হার্প’কে দেখা যায়। ইরাকের এক পুরনো কবরে যখন পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো হার্প পাওয়া গিয়েছিল – তাতে প্রমান হয়েছিল, এই হার্প ও মানুষের যোগাযোগের বয়স মিশরের পিরামিডের বয়সের চেয়েও বেশী।
ইথিওপিয়া থেকে শুরু করে ইরাক, ইজিপ্ট, লাতিন আমেরিকা ও মধ্য যুগের ইউরোপের সঙ্গীত সংস্কৃতিতে এই হার্প জড়িয়ে ছিল। অবশ্য বিভিন্ন দেশে, হার্পের বিভিন্ন সংস্করণ দেখা যায় – কোথাও তেকোনা ফ্রেমে হার্পের তার গুলো একই সারিতে সাজানো, কোথাও দুই সারিতে সাজানো, আবার কোথাও তিনটে সারিতে সাজানো। ইতালিতে প্রথম তিন সারি তারের হার্প তৈরি হয়েছিল।
ইউরোপিয়ান হার্প সংস্করণ, যা আমাদের চোখের সামনে দেখেছিলাম, তার সূচনা ইউরোপে, অষ্টম বা নবম শতাব্দীতে হয়েছিল। সেই সময় ইউরোপের সঙ্গীতে হার্পের সুরের যাদু জড়িয়ে ছিল।
তারপর যখন, নবজাগরণের সময় ইউরোপের সঙ্গীত জগতে এক বদল ঘটেছিল, সঙ্গীত আরও জীবন ধর্মী হয়ে উঠেছিল, সেই সময় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হার্পকেও খুব তাড়াতাড়ি উন্নত হতে হয়েছিল।
প্রচুর তার দিয়ে তৈরি এই জটিল বাদ্য যন্ত্র, ‘হার্প’কে উন্নত করার জন্যে ইউরোপের নানা দেশে তখন অনেক চেষ্টা হয়েছিল – কিন্তু, হার্পের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ফ্রান্সেই হয়েছিল।
ফ্রান্সের জনজীবনে হার্পের সঙ্গীতকে প্রচলনের পেছনে কিন্তু ছিলেন রানী মারী আন্তনিতে। কিশোরী মারী আন্তনিতে যখন অষ্ট্রিয়া থেকে ফ্রান্সে রানী হয়ে এলেন, অষ্ট্রিয়া থেকে তার জিনিসপত্রের সঙ্গে এসেছিল – রানীর প্রিয় হার্প। ফ্রান্সের রাজ সভায় রানী হার্প বাজিয়ে ফ্রেঞ্চদের আশ্চর্য করে দিয়েছিলেন। তাই, ফ্রান্সে হার্প মিউজিকের জনপ্রিয়তায় মারী আন্তনিতের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
আর Sébastien Érard – যিনি সেই সময়ের ফ্রান্সের বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা ছিলেন, তিনি হার্প বাজানোর ধরণে বদলের খোঁজে, প্যাডেল মেকানিজম যুক্ত করে, হার্পকে এক উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই প্যাডেল মেকানিজম দিয়ে হার্পের তারের সুরের তীক্ষ্ণতার হেরফের করা যায়।
যাইহোক, তারপর, উনিশ শতাব্দীতে ইউরোপে হার্পের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করে, কিন্তু, আবার ফ্রান্সে ফিরে এলো হার্পের সুরের জনপ্রিয়তা, উনিশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে শুরু হল ইমপ্রেশনিস্ট মুভমেন্ট, আর সেই আন্দোলন যেখানে নতুন শিল্পে রং তুলির প্রেরণার সুর তুলেছিল এই হার্পের অসংখ্য তার গুলো।
একতারার দেশের মানুষ আমরা, এদের বাদ্যযন্ত্রের অসংখ্য তারের সমন্বয় দেখে আমরা তো আশ্চর্য হবোই – এতো তার ওদের বাদ্যযন্ত্রে? তার মানে যত ভালো, সুন্দর সুর ওদেরই দখলে? একটু কি ঈর্ষাকাতর হয়ে ছিলাম?
কিন্তু, তারপরেই, আবার মনে এলো, জীবনের মূল উদ্দেশ্যই যখন সুরের ঝংকার তোলা, তবে জীবন নামের বাদ্যযন্ত্রে তারের সংখ্যা গুণে কি লাভ, তার যতটাই থাকুক – বাউলের মতো সুর তুলে যেতে হবে। আর তাতেই জীবন সুন্দর হবে, সুরেলা হবে। আমাদের সেই অতি প্রিয় কবির কথা মনে পড়ল – এক মনে তোর এক তারাতে/ একটি যে সুর সেইটি বাজা।