পারফিউম – বোতলজাত সুখ মুহূর্ত (French Perfumeries in Grasse, France)

সত্যিই কি আমরা জীবনের কোন এক ভালো, সুখের মুহূর্তের সুগন্ধকে বোতলজাত করে ফেলতে পারি? সুগন্ধ দিয়ে কি আমরা স্মৃতি ধরে রাখতে পারি?

পারি – ফরাসী পারফিউম শিল্পীরা দাবী করে – সুগন্ধ ও মানুষের স্মৃতির মধ্যে এক অদ্ভুত যোগাযোগ আছে। আর ওরা, সেই সুগন্ধকে, সুগন্ধের স্মৃতিকে বোতল জাত করে ফেলতে পারে – এর  জন্যে ওদের দীর্ঘ দিনের অধ্যবসায়, কল্পনা, বিজ্ঞান সবই কাজে লাগায়।

ফরাসী পারফিউম বিজ্ঞানী, যারা ঠিক করে দেয়, কোন সুগন্ধ পৃথিবীর মানুষের সুখ স্মৃতিকে জাগ্রত করে দেবে, কোন সুগন্ধে মানুষ মাতাল হবে, বিভোর হবে – তাদেরকে Les nez  কিংবা noses বলে।

ফরাসী সুগন্ধ বিচারক ‘nez’  দের স্কুলে সুযোগ পাওয়াও খুব কঠিন। আর ফ্রান্সের এই nez হতে হলে প্রচুর ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের পরিচয় দিতে হয় – সে বড়ই কঠিন কাজ। আর যে ফরাসী পারফিউমের ‘nez’ হতে পারে, তারা নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মনে করে।

ফরাসীরা বলে, nez হয়ে সুগন্ধ বিচার করতে পারা, এক জন্মগত প্রতিভা। হাজার হাজার ফুল ও মসলার সুগন্ধ থেকে বেছে নিতে হয়, চিনে নিতে হয়, সেই আশ্চর্য মাতাল করা সুগন্ধটিকে, যে সুগন্ধ রাগ-রাগিণীর মতো নানান সুরে, নানান তালে বাঁধা।

আর, ফরাসী পারফিউমের স্বর্গরাজ্য ও রাজধানী হল – Grasse, ফরাসী পারফিউমের প্রায় সমস্ত সুগন্ধের জন্মস্থান এই ছোট্ট গ্রাম। ফ্রান্সের এই সুগন্ধী গ্রামের নানান পারফিউমারি গুলোয় টুরিস্টদের জন্যে পারফিউমারি ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা আছে। তাই, এই পারফিউম গ্রামে এসে ফরাসী পারফিউমের নানান কথা জানা যায়, দেখা যায় এদের পারফিউম যজ্ঞ, পারফিউমের রহস্য।

ওরা বলে – কোন সুগন্ধের সঙ্গে, কোন সুগন্ধ মিলে মিশে, এক আশ্চর্য স্বর্গীয় সুগন্ধ তৈরি করতে পারে – সেও এক বিশাল রহস্য, যে রহস্য ফরাসীরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের কাছে রাখতেই পছন্দ করে এসেছে।

ফরাসী পারফিউম শিল্পীদের কাছে পারফিউম মানে এক ম্যাজিক, এর কাজই হল সুখের মুহূর্তকে ধরে রাখা, মানুষকে এক ভালো সময়ে নিয়ে যাওয়া। তাই, ফরাসী পারফিউম শিল্পীরা নির্জনে, অনেকটা সন্ন্যাসীর মতোই জীবন কাটিয়ে, প্রচুর সময় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, সেই সুখের মুহূর্তের সুগন্ধটির খোঁজ করে, সুগন্ধের স্বপ্ন বোনে। ফরাসী পারফিউমের এক একটা নোটে (Notes) যেন এক মোহ মায়াজাল সৃষ্টি হয়, উন্মাদনার সৃষ্টি হয় – সেই দিকে সর্বদা ঐ পারফিউম শিল্পীদের মনোযোগ থাকে।

ফরাসীদের কাছে পারফিউম তৈরি এক শিল্প, যে শিল্পে রসায়ন বিজ্ঞানের তীব্র জ্ঞানের সঙ্গে মিশেছে জীবনদর্শন, সুগন্ধ, কবিতা, রং, ছবি, ও কল্পনা।

একটা পারফিউমের সুগন্ধের জন্যে ওরা দিনের পর দিন গভীর গবেষণা করতে দ্বিধা করে না। আবার এক ভালো রসায়ন বিজ্ঞানী যে এক ভালো পারফিউমার হতে পারে – তা কিন্তু নয়। যার মস্তিষ্ক, সুগন্ধের প্রতিটি স্তরের যতটা সুক্ষ চুলচেরা বিচার করতে পারে, যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সুগন্ধের স্বপ্ন দেখে, সুগন্ধের খোঁজ করে, সেই নাকি এক ভালো পারফিউমার হতে পারে। আর প্রতিটি ভালো ফরাসী পারফিউম, সেই nez  দের কল্পনার জগতের কোন এক স্তরের অদ্ভুত প্রেরনায়, স্বপ্ন দেখায় সৃষ্টি হয়। আর সৃষ্টি হয় এক একটি সুগন্ধি মাস্টারপিস, যেন কোন এক স্বপ্ন জগতের সুগন্ধের খোঁজ দেয় ঐ পারফিউম গুলো।

ফরাসী nez রা বলে – পারফিউমের এক নোট যদি মসৃণ, মৃদু হয়, আরেক নোট কড়া, উগ্র ও হতে পারে – ঠিক যেমন ভাবে, শিল্পীর আঁকা ক্যানভাসে একই রঙের নানান শেড দেখা যায়, তেমনি নাকি পারফিউমের নোট গুলোতেও দেখা যায় কিংবা অনুভব করা যায়।  ওরা বলে – ফরাসী পারফিউমের এক গঠনবিন্যাস আছে, যেখানে মসৃণতা যেমন ধরা দেয়, তেমনি রুক্ষতাও ধরা পড়ে।

ওদের কাছে পারফিউম মানে, এক রোম্যান্টিক বার্তা, ভালো থাকার সুখবর, আর, যার ভাষা রসায়ন বিজ্ঞানের অনু, পরমানুর রহস্য। আর সেই ভাষায় কথা বলে Les nez   রা – যারা একাধারে শিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি। যাদের সৃষ্টি এক রহস্য, বোতলে ভরা এক সুগন্ধি তরল, এক সুখ-মুহুর্ত, এক স্মৃতি।

 

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel, Western-Europe and tagged , , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান