দুব্রভনিকের ঝর্ণা ধারা (Onofrio’s Fountain, Dubrovnik, Croatia)

জল, জল, চারিদিকে শুধুই জল, অথচ সেই দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলের এক ফোঁটাও মানুষের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে না – আর তাই, প্রাচীন এই সমুদ্র শহর দুব্রভনিকের মানুষকে পানীয় জলের সমস্যা নিবারনের জন্যে বহু শতাব্দী আগেই নানা পন্থা খুঁজতে হয়েছিল।

চোদ্দ শতাব্দীর দুব্রভনিকের রিপাবলিক যুগের সময় থেকেই, প্রাচীর ঘেরা প্রাচীন দুব্রভনিক শহরের মানুষের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার জন্যে শহর বাসীরা প্রচুর মনোযোগ দিয়েছিল।

প্রাচীন কালে দুভ্রভনিক শহরের ঘরে ঘরে কুয়ো তো ছিলই, এমনকি সমস্ত বাড়ীর ছাদ থেকে, বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে, জমিয়ে রাখার জন্যে নানা ধরণের জটিল ব্যবস্থা ছিল – যার অনেক নিদর্শন আজও দেখা যায়।

চোদ্দ শতাব্দীর শুরুতে দুব্রভনিক সরকার এক বিশাল কুয়ো তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল – যেখানে বৃষ্টির সময় শহরের সমস্ত বিল্ডিংয়ের ছাদের জল এসে জমা হত – সেই জায়গার নাম Sponza Palace। ১৩১১ তে সেই বিশাল কুয়ো তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল।

গরমের সময়ে দুব্রভনিক শহরে ভালোই গরম পড়ে, এমনকি কখনো কখনো খরাও দেখা যায় – ভাবা যায়? জলের কাছাকাছি বসবাস করেও খরার সম্মুখীন হতে হয়!

আর প্রাচীন কালে, খরার সময়ে দুভ্রভনিক শহরের কিছু দূরের এক গ্রাম ‘Mlini’  র মিষ্টি জলের ঝর্ণা থেকে, জাহাজে করে, পানীয় জল এনে ব্যবসায়ীরা স্থানীয় মানুষদের বিক্রি করতো, কিংবা জাহাজে করে জল এনে শুকনো কুয়ো গুলো ভর্তি করতো। এতেও কিন্তু, দুভ্রভনিক শহরের মানুষের পানীয় জলের আদিম ও আসল সমস্যার সমধান হয় নি।

তারপর, পনেরো শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, দুব্রভনিক শহর কতৃপক্ষ আরেক পদক্ষেপ নিল – দুব্রভনিক শহরের কিছু দূরে Šumet গ্রামের মিষ্টি জলের ঝর্ণা থেকে নালা সিস্টেম তৈরি করে, সরাসরি ঝর্ণা থেকেই দুব্রভনিক শহরে জল আনার প্রকল্প নেওয়া হল। সেই প্রকল্পের আর্কিটেক্ট ছিলেন Onofrio della Cava । এই প্রকল্পের প্রথম শর্ত ছিল – নালা দিয়ে, ঝর্ণা থেকে শহরে জল আনার পথে যেন এক ফোঁটা জল নষ্ট না হয়।

জটিল এই নালা সিস্টেম, প্রায় একশো মিটার উচ্চতার ঝর্ণা থেকে জল সংগ্রহ করে, প্রায় বারো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে দিতে, পথে চারটে জলের ট্যাঙ্ক ভর্তি করে, তবে দুভ্রভনিক শহরে আসে। Onofrio della Cava  জটিল সেই নালা সিস্টেমের মাধ্যমে দুভ্রভনিক শহরে শুধু জল এনেই থেকে থাকেন নি – দুভ্রভনিক সিটি ওয়ালে ওঠার সিঁড়ির সামনে যেখানে St. Savior church আছে, ঠিক তার পাশেই তৈরি করেছিলেন বিশাল এক জলের ট্যাঙ্ক – big Onofrio fountain ও পাশে এক ছোট Onofrio fountain । আর big Onofrio fountain টি হল ষোল-ভুজাকার বিশাল এক জলের ট্যাঙ্ক।

ষোল-ভুজাকার বিশাল এই জলের ট্যাঙ্কের প্রতিটি দিকে নানা ধরণের স্ট্যাচুর মুখ দিয়ে ক্রমাগত জল পড়তে থাকে। ট্যাঙ্কের উপরে এক গোলাকার গম্বুজ ঢাকনা – যা দূর থেকেই দেখা যায়।

যদিও সতেরো শতাব্দীর ভূমিকম্প ও সাম্প্রতিক যুদ্ধে এই জলের ট্যাঙ্ক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু আজও দুব্রভনিক শহরের প্রয়োজনীয় পানীয় জল Šumet গ্রামের মিষ্টি জলের ঝর্ণা থেকে, সেই পনেরো  শতাব্দীতে তৈরি নালা সিস্টেমের মাধ্যমেই আসে।

এবং, সেই মিষ্টি জল আজকের বিভিন্ন কোম্পানির বোতল জাত জলের মতোই যথেষ্ট পরিমাণে পানীয় যোগ্য – বরং আরও ভালো, আরও মিষ্টি বলা যায়। শুধু, কয়েক বছর আগে যুদ্ধের সময়ে দুভ্রভনিকের মানুষ এই জলের ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতো না।

ঐতিহাসিক এই শহরের মধ্যে, হঠাৎ করে এক জলের ট্যাঙ্কের অবস্থান যতই আশ্চর্য বা অদ্ভুত লাগুক না কেন – আজ, কিন্তু দুভ্রভনিক শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি প্রতীক এই  Onofrio ফাউন্টেন, আর এই জলের ট্যাঙ্কই এই শহরকে ইউরোপের অন্যান্য শহরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করেছে, বিশেষত্ব দিয়েছে, দিয়েছে এক স্বতন্ত্রতা।

সামারের দুরন্ত দুপুরে, সিটি ওয়ালের পথে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে অনেক টুরিস্ট এই ঝর্ণার জলে নিজের বোতল ভরে নিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। কিংবা, এই জলের ট্যাঙ্কের ছায়ায় ক্লান্ত টুরিস্ট, ক্ষণিক বসে বিশ্রাম নিতে পারে। স্যুভেনির কেনা বেচা, ফোটো তোলা, সঙ্গীর জন্যে অপেক্ষা, টুরিস্টদের আসাযাওয়া – সব মিলিয়ে এই Onofrio ফাউন্টেন দুভ্রভনিকের এক ব্যস্ততম জায়গা।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Croatia, Europe, Southern-Europe, Travel and tagged , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান