বিশ্ব যুদ্ধ আইনস্টাইনকে এক বিশাল উভয়সংকটে ফেলে দিল, কারণ আইনস্টাইনের খুব কাছের মানুষজন, সহকর্মী – যাদের আইনস্টাইন সম্মান করতেন, ভালোবাসতেন, যাদের সঙ্গে শুধু পেশাদারী সম্পর্ক নয়, এক বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল – তারা সবাই কেমন যেন বদলে গেল। যদিও, তিনি তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুদের ভালোবাসতেন – কিন্তু, তাঁদের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে, মন থেকে কিছুতেই যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারলেন না।
তখন, সব কিছুই খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছিল। দেশাত্ববোধ, জাতীয়তাবোধ বুদ্ধিজীবীদের সুস্থ সৃজনশীল চিন্তার পরিবেশকে কেমন যেন অবশ, সম্মোহিত করে দিয়েছিল। এমনকি, যুদ্ধে জার্মান মিলিটারিকে সমর্থন জানাতে, আইনস্টাইনের খুব কাছের বন্ধু ও জার্মানির প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীরা মিলে Manifesto of the Ninety-Three তে সাক্ষর করে, প্রকাশিত করলেন।
সেই মেনিফেস্টো তে ছিল – জার্মানিকে যুদ্ধে যোগ দিতেই হবে, আর যুদ্ধে জার্মান মিলিটারি যাই পদক্ষেপ নিক না কেন, ঐ তিরানব্বই জন জার্মান প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী ব্যক্ত্বিত্ব কোন প্রতিবাদ করবে না, প্রশ্ন তুলবে না – শুধু সহযোগিতা করে যাবে, পূর্ণ সমর্থন করে যাবে।
আইনস্টাইন তাঁর কাছের মানুষজনের বদলে যাওয়া দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন, দুঃখিতও হয়েছিলেন। তাই, সেই তালিকায় আইনস্টাইন সাক্ষর করেন নি – সেই সময় অনেকেরই সেটা পছন্দ হয় নি, কাজেই সেই সময় জার্মানির অনেকের কাছে তিনি ছিলেন দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক!
জীবনের সেই সময়ে তিনি যেন বুঝতে পারলেন – না, ফিজিক্সের রহস্যময় ইকুয়েশন গুলোর বাইরেও এক অদ্ভুত পৃথিবী আছে, যেখানে ফিজিক্সের কোন স্থান নেই! আর সেই পৃথিবীও মানুষের সমান দরকারি – তাই, আইনস্টাইন সেই সময়ের জার্মানিতে, যুদ্ধ প্রতিবাদের এক ঝুঁকি নিলেন, তিনি এক বিপরীত মেনিফেস্টো লিখলেন – যেখানে তিনি বললেন – না, শুধু দেশাত্ববোধ, জাতীয়তাবোধ নয়, জাতীয় গর্ব নয় – এর বাইরেও এক মানবিক পৃথিবী, শান্তির পৃথিবী আছে।
মাত্র চারজন সেই মেনিফেস্টোতে সাক্ষর করেছিল – আর আইনস্টাইনের সেই মেনিফেস্টো প্রকাশিতও হয় নি।
যুদ্ধের পরিবেশেও তিনি মানসিক ভাবে শান্তিকামী, যুদ্ধ প্রতিরোধী ছিলেন। তাই, যুদ্ধ প্রিয় সহকর্মীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছিল। বাস্তবিক অর্থে তিনি একাকী হয়ে গিয়েছিলেন – এদিকে, সেই সময় তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গেও বিচ্ছেদ চলছিল – তাই সবদিক থেকেই তিনি একাকী ছিলেন। আর সেই একাকীত্বই যেন তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যতই তিনি একাকী হয়ে উঠছিলেন, বিজ্ঞানে ততোই মনোনিবেশ করছিলেন।
সেই সময়ে, আবার তিনি তাঁর জেনারেল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির দিকে মনোনিবেশ করলেন – আবার একবার রিলেটিভিটি থিয়োরির জটিল অংক ও ইকুয়েশন গুলো নিয়ে বসলেন।
একদিন, জটিল অংকগুলো – যেখানে তিনি সূর্যের পাশে লাইটের বেঁকে যাওয়া গণনা করেছিলেন, সেটা দেখে বুঝতে পারলেন, কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে- আগের গণনায় একটু ভুল ছিল।
চলবে