আর, রাশিয়ার সেই যুদ্ধরত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, হঠাৎ করেই, পূর্ণ সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণে এক বাধার সৃষ্টি করল। রাশিয়ার গভীর জঙ্গলে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে ওরা কি করছে – তা দেখার জন্যে রাশিয়ার সৈনিক, ওদের ক্যাম্পে পৌঁছে গেল – ওদের দু’জনের কাছে পরিচয়পত্র চাইল।
দেখল – এক জার্মান ও তাঁর সঙ্গে টেলিস্কোপ – নির্ঘাত গুপ্তচর – সঙ্গে সঙ্গে ওরা ওর সমস্ত যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দিতে শুরু করল। রাশিয়ান সৈনিকরা, Erwin এর কোন কথা না শুনেই ওকে বন্দী করে নিল।
ওরা বলল – তোমার দেশ আমাদের উপরে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তুমি যুদ্ধ বন্দী। Erwin এর পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখার, রিলেটিভিটি থিয়োরির প্রমানের সমস্ত বৈজ্ঞানিক স্বপ্ন, যুক্তি, তর্ক রাশিয়ার সৈনিকদের সামনে ভেসে গেল ।
এদিকে, Campbell আমেরিকান, তখন আমেরিকা যুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল – তাই রাশিয়ানরা Campbell কে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখার অনুমুতি দিল। এতোটা দূর থেকে, প্রচুর যন্ত্রপাতি গভীর জঙ্গলে নিয়ে এসে সূর্যগ্রহণ দেখার দিনেই প্রকৃতি বাদ সাধল – সেই দিনই কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল আকাশ। সূর্য গ্রহণ পর্যবেক্ষণ অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল – কিছুই দেখা গেল না। Campbell কেও পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে হল।
কয়েক মাস ধরে Erwin ও তাঁর দল, রাশিয়ার জেলে যুদ্ধ বন্দী, সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণে ব্যর্থতা সব মিলিয়ে আইনস্টাইনকে এক বিষণ্ণ সময় ঘিরে ধরছিল। সেই সময়, আইনস্টাইনের জেনারেল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি প্রমানের সমস্ত আশাও যেন অনেকটা যুদ্ধ বন্দী হয়ে গেল। আইনস্টাইন মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়লেন – দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর থিয়োরির প্রমানের আশা ও গণনায় এক বিশাল বাধার সৃষ্টি – মেনে নিতে তাঁর কষ্টই হচ্ছিল।
যুদ্ধ সেই সময়ের ইউরোপে, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার স্বাধীন আদানপ্রদানে রাতারাতিই এক বিরাট রাজনৈতিক বাধার সৃষ্টি করল – ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে সমস্ত ধরণের স্বাধীন বৈজ্ঞানিক সম্পর্কে ছেদ পড়ে গেল।
এদিকে আবার, আমেরিকা যখন যুদ্ধে যোগ দিল, Campbell এর দৃষ্টি ভঙ্গিও বদলে গেল। পূর্ণ সূর্যগ্রহনের সমস্যাটিকে তিনি অন্যরকম ভাবে দেখতে শুরু করলেন। তিনি সম্পূর্ণ ভাবে সূর্য গ্রহণ পর্যবেক্ষণের কাজে মনোনিবেশ করলেন – এবার একা, কারণ জার্মান যুবক Erwin তো তখন শত্রুপক্ষ – যুদ্ধের উত্তাপ মানুষকে, বৈজ্ঞানিককেও বদলে দেয়।
এদিকে, বার্লিনেও তখন দেশভক্তির এক জোয়ার এসেছিল, যে জোয়ার সুস্থ মানুষের চিন্তাধারাকে ধীরে ধীরে অবশ করে দিচ্ছিল – আইনস্টাইন এমনি এক পরিবেশে যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেন। তাঁর ঘরের জানালা দিয়ে দেখতেন – জার্মান দেশ ভক্ত উৎসাহী যুবকের ফ্ল্যাগ মার্চ – আইনস্টাইন তো মন থেকে এমন পরিবেশে থাকতে চান নি। তিনি কাজ করে যেতে চান, বিজ্ঞানে মন দিতে চান। কিন্তু, সব যেন উল্টো পাল্টা হয়ে যেতে লাগল।
আইনস্টাইনের খুব কাছের বন্ধু ও সহকর্মী রসায়ন বিজ্ঞানী Fritz Haber ও যুদ্ধ নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন – জার্মান আর্মির সঙ্গে মিলে Fritz Haber যুদ্ধের জন্যে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস তৈরি করতে আরও বেশী উৎসাহী ছিলেন। Fritz Haber এর মতে তিনি এমন এক বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করতে পারবেন, যাতে বিপক্ষের প্রচুর সৈনিককে একসঙ্গে মেরে দিয়ে, খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করা যাবে – এমনকি, তিনি তা করেও ছিলেন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে, বেলজিয়ামের যুদ্ধক্ষেত্রে, Fritz Haber এর গবেষণাগারে তৈরি বিষাক্ত গ্যাস-বোমা বিপক্ষের উদ্দেশ্যে প্রথম ছোড়া হয়েছিল – যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রথম ভয়ানক এক ঘটনা ছিল – সেই যুদ্ধক্ষেত্রে Fritz Haber স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, সেই বোমা ছোড়ার আদেশ দিয়েছিলেন – Fritz Haber নিজের চোখে, তাঁর তৈরি গ্যাসে, প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যু দেখেছিলেন।
আইনস্টাইনের কাছে, তাঁর খুব কাছের বন্ধুর এই কাজকে, পাগলামির এক শেষ পর্যায় বলে মনে হয়েছিল। আইনস্টাইন মতে – বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রযুক্তিগত কুঠারটি যেন এক উন্মাদ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
চলবে