একটি ভাঙ্গা চেয়ার (Broken Chair, Geneva, Switzerland)

ভাঙ্গা দুই রকমের হতে পারে – এক মসৃণ ভাবে ভাঙ্গা, যেমন – কাঁচ ভাঙ্গে। দুই, দুমড়ানো মোচড়ানো ভাঙ্গা, যে ভাঙ্গায় এক তীব্র বেদনা, যাতনা, কষ্ট প্রকাশ পায়, যেমন – গাছের ডাল ভাঙ্গে। ঠিক তেমনি দুমড়ানো মোচড়ানো ভাবে এক পা ভাঙ্গা একটি বিশাল, বারো মিটার উচ্চতার কাঠের চেয়ার, জেনেভার রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাসাদের সামনে কি করছে? সুইজারল্যান্ডের স্বপ্নিল সৌন্দর্যের দেশে ঐ বিশাল ভাঙ্গা চেয়ারের উপস্থিতির কি প্রয়োজন? জানলাম – প্রয়োজন তো আছেই – ঐ চেয়ার যে প্রতিবাদের এক ভাষা, মূর্তি, প্রতীক।

ঐ বিশাল চেয়ার, ল্যান্ড মাইন ও  cluster bomb ব্যবহারের বিরোধীতার এক প্রতীক। ঐ ভাঙ্গা চেয়ার যেন রাষ্ট্রসঙ্ঘে আসা, নানা দেশের রাজনৈতিক ব্যক্ত্বিত্বদের মনে করিয়ে দিতে চায়, ল্যান্ড মাইন নিরীহ সাধারণ মানুষদের কি ভাবে ক্ষতি করে চলেছে। ল্যান্ড মাইন ব্যবহার বন্ধ না করলে, একদিন হয়তো ওরা যে চেয়ারে বসছে, সেই চেয়ারের একটি পায়ের নিচেও একটা ল্যান্ড মাইন থাকতে পারে, ওদের চেয়ারের একটি পা ভেঙ্গে যেতে পারে।

ইউরোপ জানে, যুদ্ধের শেষে ল্যান্ড মাইন পৃথিবীর নানা দেশে কি পরিমাণে ক্ষয় ক্ষতি করে চলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী ল্যান্ডমাইন আক্রান্ত দেশ – ইজিপ্ট।  গত পনেরো বছরে মিশরের মরুভূমি গুলো থেকে এক কোটির উপরে ল্যান্ড মাইন উদ্ধার করা হয়েছে, আরও কতো যে ল্যান্ডমাইন মাটির নীচে মানুষের জন্যে ওত পেতে আছে তার হিসাব নেই – ইজিপ্টের মাটিতে এতো বেশী ল্যান্ড মাইন, যে ইজিপ্টের মরুভূমিকে The Devil’s Garden বলা হয়। আর সেই শয়তানের বাগানে কতো হাজার নিরীহ মানুষ, শুধু হেঁটে যেতে গিয়ে বলি হয়েছে, তার হিসাব কে রাখে।

নব্বইয়ের দশকে বালকান দেশ গুলোয় যুদ্ধ কালীন সময়ে, মাত্র পাঁচ বছরে বসনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক লক্ষ মাইন পোঁতা হয়েছিল, আর ক্রোয়েশিয়ার যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও সেই বিস্তৃত অঞ্চলে এখনো ল্যান্ড মাইন গুলো পোঁতাই আছে। এখনো, ক্রোয়েশিয়ার সেই বিস্তৃত মাইন ফিল্ড সাধারণের জন্যে মৃত্যু ফাঁদ হয়ে আছে।

সাতানব্বইয়ে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও, এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো নিরীহ মানুষ সেই মাইনে পা দিয়ে নিহত হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা মাইন খুঁজে নিষ্ক্রিয় করার জন্যে ইঞ্জিনিয়ার মোতায়েন ছিল তারাও ছিল। আর মাইনের জন্যে আহত যে কতো মানুষ হয়েছে, সে হিসাব বোধহয় যুদ্ধ আক্রান্ত দেশ গুলো রাখতেও ভুলে গেছে।

মাটির নীচে নির্বিচারে পোঁতা মাইন ক্রোয়েশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে, প্রতি বছর মাটির নীচে মাইন খোঁজা ও নিষ্ক্রিয় করার কাজে ক্রোয়েশিয়া প্রচুর অর্থ ব্যয় করে চলেছে। শুধু তাই নয়, ক্রোয়েশিয়া মাইন খোঁজার নানান অভিনব পন্থার আবিষ্কার করার চেষ্টা করে চলেছে – ইঁদুর, কুকুর ওদের তো মাইন খোঁজার কাজে ব্যবহার হচ্ছিলই, এমনকি, মৌমাছিদেরও মাইন খোঁজার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে।

যেহেতু, ক্রোয়েশিয়ার অর্থনীতি পর্যটন নির্ভর তাই যুদ্ধের পরেই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে নানান টুরিস্ট গন্ত্যব্য সহ, ক্রোয়েশিয়ার বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্ক সংলগ্ন Plitvice Lakes এর জায়গা গুলোর মাইন খুঁজে নিষ্ক্রিয় করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল।

তবে, এখনো ক্রোয়েশিয়ার সমস্ত জমি মাইন মুক্ত হতে পারে নি – শহর ছাড়িয়ে একটু বাইরের দিকে গেলেই সাইনবোর্ডে আঁকা মাইনের সতর্কবাণী দেখা যায়। বর্তমানে ক্রোয়েশিয়ার বিস্তীর্ণ জমিতে মাইন এমন এক সমস্যা, যার জন্যে দেশটির কৃষি, শিল্প ইত্যাদির উন্নতিও থমকে আছে। চাষের জমির দূষণ, নিরীহ মানুষের মৃত্যু, অর্থনীতিতে মন্দা, আতঙ্ক, আশঙ্কা – জমিতে পোঁতা মাইন এ ছাড়া আর কি দিতে পারে?

তাই, যে প্রতিবাদের গুঞ্জন স্তিমিত হওয়ার কথা ছিল, আজ তা চিৎকারে, আর্তনাদে পরিণত হয়েছে। সাতানব্বইয়ে জেনেভার Palais des Nations এর সামনে এই বিশাল ভাঙ্গা চেয়ারটি মাত্র তিন মাসের জন্যে রাখা হয়েছিল – কিন্তু, ল্যান্ড মাইন পৃথিবীর নানা দেশে যে পরিমাণ নিরীহ মানুষের ক্ষতি করে চলেছে, ল্যান্ড মাইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে, জেনেভার রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাসাদের সামনে বিশাল ভাঙ্গা চেয়ারটি আজও রয়ে যায়। পলিসি মেকারদের চেতনাকে একটু নাড়া দিয়ে বিবেককে জাগিয়ে দিতে চায় – ঐ ভাঙ্গা চেয়ার।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, Switzerland, Travel, Western-Europe and tagged , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান