ওয়াটস এপ, ই মেল, মোবাইল, টুইটার, গুগুল হাং আউট, ফেসবুকের যুগে একটা পোস্ট কার্ড পাওয়ার যে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ ছিল, তা একেবারে ভুলেই গেছি – কত দ্রুত আমরা এগিয়ে চলেছি, পেছনের ছবি, ছেলেবেলার ছবি কতো দ্রুত ঝাপসা হয়ে চলেছে। কিন্তু, ইউরোপের মানুষ সেই পোস্টকার্ড পাওয়ার নস্টালজিক রোমাঞ্চকে, নস্টালজিক অনুভূতিকে আজও জীবিত রেখেছে – তাই ইউরোপের যেখানেই গেছি, সুভেনিরের দোকানে সেই জায়গার ছবি সহ প্রচুর পোস্টকার্ড সাজানো দেখেছি – এক একটা পোস্টকার্ডের দাম পঞ্চাশ সেন্ট থেকে দুই ইউরো।
এখানে অনেকেই কোথাও বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে নিজের নামে, নিজের ঠিকানায় পোস্টকার্ড পাঠায় – ফিরে গিয়ে অনেক দিন পরে সেই পোস্টকার্ড পেয়ে আবার ভ্রমণের সুখ স্মৃতি জাগ্রত হয়, সেই পোস্টকার্ড নিজের কাজের জায়গায় সাজিয়ে রাখে।
এখানে অনেককেই দেখেছি, পোস্টকার্ড পাঠাতে ও পেতে ভালোবাসে। আমরা যখনই দেশে যেতাম, এক ফরাসী বন্ধু বার বার করে বলে দিত – ওখান থেকে আমাকে একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ো যেন।
সেদিন, তুলুসের পার্কে এক বয়স্ক ফরাসী ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে, এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন – আমাকে এই পোস্টকার্ডে একটু হিন্দিতে লিখে দিতে পারবে? আমার ছেলে ইন্ডিয়া বেড়াতে গেছে, তাকে পাঠাবো। আমি লিখে দিলাম, তিনি নীচে নিজের সাক্ষর করলেন। হয়তো প্রতিদিনই ফোনে কথা হয়, স্কাইপে দেখা হয়, কিন্তু, এক পোস্টকার্ডে নিজের হাতে কয়েক কথা লিখে পাঠানোর সেই পুরনো অনুভূতি ওরা যেন এখনো ছাড়তে পারে নি।
হঠাৎ সেদিন হলুদ দুপুরে এক পোস্টকার্ড পেয়ে অদ্ভুত এক নস্টালজিক আবেশ ঘিরে ধরল – বন্ধুটি মালয়েশিয়া থেকে পোস্ট কার্ড পাঠিয়েছে, তার নিজের হাতে লেখা কিছু কুশল বার্তা ও পোস্টকার্ড এক ছুটে ছেলেবেলার দিনে নিয়ে গেল – বাবার নামে পিয়ন পোস্টকার্ড দিয়ে গেলে, তাড়াতাড়ি করে পড়ে নেওয়ার রোমাঞ্চ মনে পড়ল।
আমরা অতি দ্রুত এগিয়ে চলেছি, পুরনো সব জিনিস বাতিল করে করে, নতুন নতুন জিনিসে অভ্যস্ত হচ্ছি বলে, সব পুরনো জিনিস তো আর খারাপ নয় – পুরনো জিনিস অনেক সময় তো এক স্মৃতি নিয়ে আসে। আধুনিকতা এক তীব্র বানের স্রোত – সব পুরনো স্মৃতি, পুরনো মূল্যবোধ, পুরনো চিন্তা, পুরনো স্থাপত্য, পুরনো আসবাব সব ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু, কালের কষ্টি পাথরে যাচাই করে যে পুরনো চিন্তা, যে পুরাতন রয়ে যায় মানুষের মনে, তাই বোধহয় আজকের আধুনিকতা। আধুনিকতা মানে শুধু নতুন চিন্তা নয়, আধুনিকতা মানে পুরনোকে নতুন ভাবে আগত প্রজন্মের সামনে পেশ করার নাম – পুরনোকে ভালো করে না অনুভব করলে যে ঠিক ভাবে মনে প্রানে আধুনিকও হওয়া যায় না।