পৃথিবীর বুকে কত কি বদলে যায়। বদলে যায় মানুষ, বদলে যায় জায়গা, সেই জায়গার দৃশ্য, স্থাপত্য, জলবায়ু – সব, সবই পৃথিবীতে বদলায়, উন্নত থেকে উন্নততর হয় মানুষের জীবন যাপন। বদলই যে পৃথিবীর নিয়তি, তবুও ঐতিহাসিক ইউরোপের ঐতিহাসিক শহরের কিছু মানুষ যেন তাদের জীবন যাপনে সেই বদলকে দু’ হাত দিয়ে আটকে রাখতে চায় – আর সেই বিশেষ ব্যবহার প্যারিসের নানা জায়গায় চোখে পড়ে।
ওরা ভালোবাসে পুরনো ঘর, পুরনো গান, পুরনো ছবি – আর প্যারিসের স্থাপত্যের মধ্যে এক অতি পুরনো ছাপ, সেখানের মানুষের সেই নস্টালজিক ভালবাসাকে ধরে রাখে – তাই মনে হয় প্যারিস রোম্যান্টিক শহর, ভালোবাসার শহর, প্রেমের শহর বলেই পরিচিত।
প্যারিস মানুষের সমস্ত অনুভূতিকে যেমন প্রশ্রয় দেয়, তেমন করে বোধহয় পৃথিবীর অন্য কোন বড় আধুনিক শহর প্রশ্রয় দেয় না। আর সেই প্রেমের শহরের প্রধান পরিচয় হল ‘তালা’ – এখানে একটি তালায় লেখা হয় যুগলের যুগ্ম জীবন কাহিনী।
প্যারিসের বৃষ্টি ভেজা বিকেলের প্রেক্ষাপটের একদিকে নত্রে দামের গাম্ভীর্য, সিয়েন নদীর উপরের সেতু Pont de l’Archevêché রেলিং এ লক্ষ তালা – যেন প্যারিসের সেই রোম্যান্টিক পরিচয়, রোম্যান্টিক ছবি আর বেশী করে ফুটিয়ে তোলে। সিয়েনের উপরে Pont de l’Archevêché র রেলিং এর লক্ষ তালারা অতীতের কতো যুগলের গল্পই না বলে – ঐ সমস্ত তালার চাবি কিন্তু শুরুতেই তালা মেরে দিয়ে সিয়েনের গভীর জলে ছুঁড়ে ফেলতে হয়, সেটাই নিয়ম।
কিন্তু, ঐ যে বললাম পৃথিবীতে সব বদলায়, বদলই পৃথিবীর নিয়তি, সিয়েনের উপরে Pont de l’Archevêché সেতুও বদলে গেছে। পৃথিবীর নানা দিকের যুগলের লাগানো তালার ভারে সেতুর রেলিং ঝুঁকে পড়তে পড়তে ভেঙ্গে পড়েছে। প্রতিদিন প্রচুর তালা যোগ হতে হতে ঐ সেতুর রেলিং গুলোর খুব ওজন বেড়ে গিয়েছিল – প্রাচীন সেতু অনেক ভারী হয়ে গিয়েছিল।
আসলে সেতু যখন তৈরি হচ্ছিল, কেউ তো আর তালার বাড়তি ওজনের কথা ভাবে নি, ভাবে নি প্যারিসের মানুষের রোমান্টিকতা এতো ভারী হবে – তাই সেই প্রাচীন সেতু Pont de l’Archevêché কে বাঁচাতে প্যারিসের এই ভালোবাসার সেতুতে তালা ঝোলানো এক্কেবারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে – শুধু নিষিদ্ধ নয় অপরাধ বলেও গণ্য হতে পারে। ২০১৪ থেকে এই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
কিন্তু, পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের ভালোবাসার তালা যে শহর এতো দিন ধরে ধারণ করেছিল, তা এতো সহজে হারিয়ে যাবে? এই রোম্যান্টিক শহরের মানুষ কি তা হতে দেবে? প্যারিসের এক ছাত্র সম্পূর্ণ Pont de l’Archevêché সেতুটিতে লাগানো এক একটি তালার ফটো তুলে তুলে এক ওয়েবসাইট তৈরি করেছে – যারা ঐ সেতুতে তালা লাগিয়েছিল, তারা ঠিকই ঐ ওয়েবসাইটে নিজেদের তালা খুঁজে পাবে। প্যারিস ও প্যারিসের মানুষ যে কিছুতেই মানুষের সেই মধুর অনুভূতি গুলোকে ফিকে হতে দেবে না।
হয়তো যারা Pont de l’Archevêché সেতুতে তালা ঝুলিয়েছিল, তাদের কথা ছিল, অনেক অনেক দিন পরে, জীবনের শেষ প্রহরে, বহু পথ চলার পরে তারা আবার এই রোম্যান্টিক শহরে ফিরে আসবে – সেই দিন এমনি শীতের ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে প্যারিস হয়তো হবে আরও ধূসর, ঐতিহাসিক, গম্ভীর, আরও রোম্যান্টিক। আর সেই যুগল শীতের প্যারিসে, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ভেজা পুরনো পথে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো আবার ফিরে পাবে তাদের পুরনো দিনের পুরনো কথা, পুরনো হাসি, পুরনো ছন্দে পথ চলা, পুরনো টুকরো সময় – যৌবনের শুরুতে প্যারিসের পথে চলতে চলতে যে তালা ওরা রোমান্টিকতার প্রতীক রূপে প্যারিসের Pont de l’Archevêché এর রেলিং এ ঝুলিয়েছিল, তা হয়তো আবার ওরা খুঁজে পাবে – প্যারিস যে সব প্রেম, সব রোমান্টিকতা ধরে রাখে। কিন্তু, বদল তো জীবনে মেনে নিতেই হয়।