কোন এক নতুন দেশে বেড়াতে গিয়ে সেই জায়গার স্থানীয় স্থাপত্য, ইতিহাস, মানুষ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সবই টুরিস্টদের জন্যে এক বিশাল পাওয়া। আর সেই পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি সেই জায়গার সমস্ত ব্যবহারিক শিল্পের এক স্থানীয় মেলায় মধ্যে গিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগাই বলা যায়।
জুলাইয়ের শেষ বিকেলে লাটভিয়ার রাজধানী রিগার বাস ষ্টেশন থেকে হোটেলে যাওয়ার পথের পাশে বিশাল এক পার্কে দেখি শান্ত এক শিল্প মেলা বসেছে। এই দেশে এসেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টা, আমাদের কাছে সবই নতুন, এমনকি এই দেশের পার্কের গাছের ধরনও ইউরোপের অন্য জায়গা থেকে আলাদা – পার্কের সোজা সোজা গাছ গুলো যেন আকাশ ছোঁয়ার নেশায় মগ্ন।
নতুন দেশে এসে দিনের শেষের এই ধরণের শান্ত এক মেলার অদ্ভুত এক তীব্র আবেদন কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারি না। নতুন দেশের মানুষ ও তার তৈরি শিল্প দেখার লোভে হোটেলে পৌঁছেই বেশ তাড়াতাড়িই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
সাধারণত ইউরোপের প্রায় সমস্ত সুপারমার্কেট চীনের তৈরি জিনিসের দখলে, কিন্তু রিগার এই স্থানীয় মেলার জিনিস পত্রে যেন চীনের ছোঁয়াকে খুবই সচেতন ভাবে এড়িয়ে গেছে এখানের স্থানীয় মানুষরা – নিজেদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার সযত্ন প্রয়াস মেলার প্রতিটি কোণে। সে প্রাচীন কালের কয়লার উনুনে স্যুপ, বা রোস্ট ভেড়ার মাংস রান্না করা থেকে নিয়ে অ্যাম্বারের হার, কানের দুল, কাপড়ের পুতুল, কাঠের হাতা, ঝুড়ি তৈরি, হাতে বোনা সোয়েটার, টুপি, মোজা – সব কিছুতেই উঠে এসেছে লাটভিয়ার স্থানীয় মানুষের শিল্প চেতনা, তাঁদের সহজ সরল জীবনের এক ছবি। প্রায় পাঁচশো ধরণের ব্যবহারিক শিল্পীরা এখানে তাঁদের শিল্পের প্রদর্শনী করেছে – ছুতোর, কুমোর, অ্যাম্বার গহনা শিল্পী থেকে শুরু করে দর্জি, পুতুল শিল্পী, ঝুড়ি শিল্পী সবাই এখানে সাজিয়েছে তাঁদের শিল্প কর্ম।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে নতুন জায়গার মানুষ, জিনিস পত্র দেখতে দেখতে এক জায়গার জটলা দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখি সবাই এক বিশেষ ধরণের আলুভাজা কেনার জন্যে ভিড় করেছে। একটা সাধারণ মাপের সামান্য আলুকে একটা বড় বাঁশের কাঠির মধ্যে অদ্ভুত উপায়ে জড়িয়ে দিয়ে গ্রিল করে করে বিক্রি করছে – দাম এক লাটভিয়ান লাট। দেওয়ার আগে অবশ্য একটু নুন, গোল মরিচ ছিটিয়ে দিচ্ছে।
পৃথিবীর সবাই বোধহয় অতি সাধারণের অসাধারণ রূপ দেখতেই পছন্দ করে, তাই, সেই কাঠি আলু ভাজা খেয়েও দেখি পাশের এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের কৌতূহল কিছুতেই নিবৃত হচ্ছে না, তিনি ঐ আলু কাটার মেশিনটিও কিনে নিতে চান। বার বার দোকানের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করছেন – কোথা থেকে কিনেছ এই মেশিন? কিন্তু দোকানের ছেলেটি কিছুতেই ওর ট্রেড সিক্রেট বলবে না। বরং বলছে – আমি নিজে ডিজাইন করেছি। যাইহোক, আলুভাজাটি খেতে কিন্তু মন্দ ছিল না।
স্থানীয় পোশাকের সাজে নানা বয়সী স্থানীয় মানুষের জটলা, টুরিস্ট, মেলায় সাজানো জিনিস দেখতে দেখতে সময় কেটে যায় – সন্ধ্যা হয়ে পড়ে। আর নতুন জায়গার নতুন স্বাদ নিতে নিতে সেই মেলা দেখাই ছিল আমাদের সেই লাটভিয়ান বিকেলের উদ্দ্যেশ্য।