জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল (Rastovača, Croatia)

জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা আগে তো কখনো ছিল না, তাও আবার ক্রোয়েশিয়ার জঙ্গলে। প্রথমে শুনেই বেশ রোমাঞ্চ হয়েছিল। জঙ্গল বলতে আমাদের মনে যা ভাসে, খারাপ রাস্তা ঘাট, অন্ধকার, সভ্যতার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই – এমনি এক ছবি।

কিন্তু, ক্রোয়েশিয়ার এই বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্ক ও জঙ্গল লেক খুবই উন্নত মানের রাস্তা দিয়ে ক্রোয়েশিয়ার বড় শহরের সঙ্গে যুক্ত। ক্রোয়েশিয়ায় আসার আগে কোলকাতার এক বন্ধু বলেছিল – শুনেছি, সাম্প্রতিক যুদ্ধে ওদের দেশের রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে গেছে, বাস গুলোর চলাচলের কোন সময় জ্ঞান নেই? কিন্তু, এখানে এসে দেখি ব্যপার সম্পূর্ণ আলাদা। মসৃণ রাস্তায় চলন্ত বাসে বসে কফির কাপ থেকে এক বিন্দু কফি ছলকায় না, ঘড়ির কাটার সময় মেনে চলে সমস্ত বাস।

যুদ্ধের পরেই ক্রোয়েশিয়ার সরকার ঢেলে সাজিয়েছে ওদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার পরি কাঠামো, রাস্তাঘাট। আর পর্যটন শিল্পকে বিদেশীদের জন্যে করে তুলেছে আরামদায়ক ও আকর্ষণীয়। স্প্লিটে যে হোটেলে ছিলাম, তার মালিক জানিয়েছিল – ক্রোয়েশিয়া খুবই সেফ, ক্রোয়েশিয়ায় কেউই ঘরে তালা মারে না।

যাইহোক, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের শুরুতে বাস যখন জঙ্গল এলাকায় ঢুকে পড়ল, চারিদিকের ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে বুঝলাম আশেপাশে কোন জন বসতি নেই। ইন্টারনেট মানুষের জীবনকে অনেক সহজ করেছে, যেমন এখানে আসার আগে জেনে এসেছিলাম বাস চালককে অনুরোধ করলে হোটেলের আশেপাশে নামিয়ে দিতে পারে। তাই জঙ্গলের অন্ধকার, নির্জনতা দেখে খুব একটা আশঙ্কা হয় নি।

হাসিখুশি ড্রাইভার ঠিকই আমাদের হোটেলের কিছু দূরে সামনের হাইওয়ের পাশে নামিয়ে দিল। দু’পাশে ঘন জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার যেন আমাদের চেপে ধরেছে। ইউরোপে এসে প্রথম টর্চ ব্যবহার করতে হল। হাইওয়ের পাশে হাঁটার একদমই রাস্তা নেই, মাঝে মাঝে তীব্র গতিতে এক দু’টো গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, আর আমরা যতটা সম্ভব রাস্তা ছেড়ে হাঁটতে চেষ্টা করছি, আর পথ দেখাচ্ছে এক ছোট্ট টর্চের হালকা নীলাভ আলোর বৃত্ত।

প্রায় দু’শো মিটার হাঁটার পরেই ডানদিকে দেখি হালকা হলুদ নিওন আলোয় সাজানো আমাদের হোটেলের নাম, ও হলুদ আলোর এক আঁকাবাঁকা পথ চলে গেছে গাছ পালায় ঘেরা এক সুন্দর বাড়ীর দিকে। সেটাই হোটেল, এক পরিবার এই হোটেল চালায়। অন্ধকার বাড়ীর সামনে যেতেই আশপাশের আলো জ্বলে উঠল, পাশে কুকুরের এক ছোট্ট ঘর থেকে কুকুরের ডাক শোণা গেল – দরজাতেই অপেক্ষা করছিল হোটেলের মালিক। অবশ্য আমরা আগেই হোটেলের মালিককে ফোন করে দিয়েছিলাম।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রাতে এখানে বেশ ঠাণ্ডাই পড়ে। ভেতরের উষ্ণতায় বেশ আরাম বোধ হল। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে একদম উপর তলায় আমাদের রুম, পাশে এক ছোট্ট রান্নাঘর – চাইলে খাবার তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।

রাতে হোটেলের জানালা থেকে বাইরের মিশকালো অন্ধকার দেখে বুঝতেই পারি নি যে, কেমন জঙ্গল ঘেরা জায়গায় এই হোটেলের অবস্থান। ভোর হতেই জানালার ছোট্ট বেলকনি থেকে দেখি, সামনেই পাহাড় শ্রেণীর গায়ে থমকে আছে ভোরের কুয়াশা, আর ঘন জঙ্গল। আমাদের ঠিক সামনের রুমেই ইংল্যান্ড থেকে আগত চারজনের এক বয়স্ক দল দেখি ভোর হতেই তৈরি হয়ে বেরোনোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন।

হোটেলের বাগান এলাকায় নানান ফলের গাছ, আর সামনেই পাহাড়ের গায়ে, খাদের পাশ দিয়ে, জঙ্গলের মধ্যে চলে গেছে ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার সরু শর্টকাট রাস্তা। এই হোটেলে যারাই থাকে সেই সরু রাস্তা ধরে প্লিটভিস লেক পার্কে ঢোকা তাঁদের কাছে যেন এক বিশেষ পাওয়া, উত্তেজনা, এক রোমাঞ্চকর এডভেঞ্চার।

জীবনের কোন কোন সময়ের বা দিনের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, দৃশ্য যেন তীব্র ভাবে মনে দাগ কেটে যায়। আর সেই স্মৃতির পটের জীবন ছবি বহমান জীবনের ব্যস্ততায়, নানা কাজের ভিড়ে হঠাৎ করে উঁকি দিয়ে যায়। সে অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অঝোর তুষার পাতের ধূসর দুপুরে সুইস আল্পসের কোলে কোন এক গ্রামের ক্যাফেতে বসে গরম কফির কাপে চুমুক দেওয়ার উষ্ণ সুখানুভুতি হোক, বা পর্তুগালের এক নির্জন গ্রাম পিনহাও-এর ট্রেন ষ্টেশনে আঁকা ছবির মাধুর্যই হোক কিংবা ক্রোয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিশি যাপনের রোমাঞ্চই হোক – জীবনের পথে চলতে চলতে সেই ছবি গুলোই মুখে ফুটিয়ে তোলে মুচকি হাসি।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Croatia, Europe, Southern-Europe, Travel and tagged , , , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান