ডাইনোসর যুগের পার্কে (Meze dinosaur park, South France)

আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে দুরন্ত গরমে, ঠিক দুপুর বেলায় দক্ষিণ ফ্রান্সের এই প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর পার্কের আকাশ ছোঁয়া গাছের জঙ্গলের ভেতরে তীক্ষ্ণ আওয়াজে লক্ষ লক্ষ ঝিঁ ঝিঁ পোকারা একটানা গলা সাধে, এখানে এসে ক্রমাগত সেই আওয়াজ শুনে কানে তালা লেগে যেতেই পারে। তবে, এই অদ্ভুত পার্কের পরিবেশে কিছুটা প্রাগৈতিহাসিক ছোঁয়া বোধহয় ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজেও অনুভব হয়, মনে হয় – সত্যি যেন এক আদিম গভীর জঙ্গুলে পরিবেশে চলে এসেছি।

দক্ষিণ ফ্রান্সের এই অঞ্চলে ডাইনোসরের অস্ত্বিত্ব পাওয়া গিয়েছিল, ওদের বিশাল বিশাল ডিমের প্রস্তর দশা এখানে পাওয়া গিয়েছিল। এখনো এই অঞ্চলের বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলে ডাইনোসরের দেহাবশেষের সন্ধান চলছে। তবে সন্ধান যাই পাওয়া যাক না কেন, বৈজ্ঞানিকদের মনের ধারণা ও কল্পনা শক্তিকে প্রকাশ করতে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের বড় বড় নানান প্রজাতির ডাইনোসরের অবয়ব খাড়া হয়ে গেছে।

অবশ্য এই পার্কে শুধু যে বাচ্চাদের কৌতূহল নিরসন হয় তা নয়, বড়রাও সমান উৎসাহে বিগত দিনের এই প্রাণীটির আদ্যপান্ত জেনে নিতে চায়। অতিকায় সেই ডাইনোসররা কি ভাবে ডিম দিত, ওদের ছানা হত, শিকার করতো, কি খেত, মাংসাশী ছিল না তৃণভোজী ছিল, কেমন ছিল সেই অতিকায় দৈত্যের মতো প্রাণীর পায়ের ছাপ, জীবন সংগ্রাম – সবই বিশাল এই পার্কের জঙ্গুলে পথে চলতে চলতে জানা হয়ে যায়। এখানে ঢুকে বিশাল গাছের ছায়ায় অতিকায় ডাইনোসরের মডেলের সামনে দাঁড়িয়ে সময়ের হাত ধরে এক ঝটকায় চলে যেতে হয় পৃথিবী সৃষ্টির সেই আদিম দিন গুলোতে। জানি না, সেই সময়ে ডাইনোসরের সঙ্গে মানুষও যদি পৃথিবীতে থাকতো, মানুষের সঙ্গে ঐ প্রাণীটির কতটা বন্ধুত্ব হত।

আগস্টে দক্ষিণ ফ্রান্সের তুলুস অঞ্চলে বেশ ভালোই গরম পড়ে। গরমে তুলুস শহরটি একদম শুনশান হয়ে যায়, দুপুরে বেরোলে খুবই কম লোকজন চোখে পড়ে। শহর খালি করে সবাই পাড়ি দেয় সমুদ্র তীরে। সেবার আমরাও ঠিক করে নিলাম – তুলুসে থেকে আর গরম সহ্য করবো না, তুলুসের কাছে বেশ কয়েকটা সমুদ্র তট আছে, কয়েকদিনের লম্বা ছুটিতে এক এক দিন করে, এক এক সমুদ্র তটে কাটিয়ে ফিরব তুলুসে। সমুদ্র তট গুলোর পাশে ক্যাম্পিং এর প্রচুর জায়গা আছে, তাই ক্যাম্পিং এর সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

সেদিন এই পথে Pezenas থেকে Meze এর দিকে যেতে গিয়ে পথের পাশে, জঙ্গলের বাইরের বিশাল ডাইনোসরের এক স্ট্যাচু আমাদের নজর কেড়ে নিয়েছিল। সেদিনই ঠিক করেছিলাম পার্কের ভেতরে একবার উঁকি দিয়ে যাব – ঐ অহেতুক কৌতূহল নিবারণ করে যাব। এতদিন এখানে থেকেও এই পার্ক সম্বন্ধে তো এক্কেবারেই জানতাম না! আবার তাই পরের দিন ফিরে এসেছিলাম। বড় রাস্তা থেকে নেমে গাড়িতে অনেকটাই ভেতরে যেতে হয়। চারপাশে ঝোপ ঝাড়, চাষের জমি, জঙ্গুলে রাস্তা – জনবসতি নেই বললেই চলে। উঁচু টিলার উপরে জঙ্গল ঘেরা এক নির্জন জায়গায় দক্ষিণ ফ্রান্সের বিশাল এই ডাইনোসর পার্ক – Meze Dinosaur Park, ইউরোপের সবচেয়ে বড় ডাইনোসর মিউজিয়াম পার্ক। কিছুদিন আগেই এখানে নাকি ডাইনোসরের এক নতুন প্রজাতির দেহাবশেষের সন্ধান পাওয়া গেছে – আগে পৃথিবীর কোথাও এই ধরণের ডাইনোসর ফসিলের সন্ধান পাওয়া যায় নি।

পৃথিবীর নানা কোণে কতো শিল্প, কতো আশ্চর্য সৃষ্টি ছড়িয়ে আছে, আমরা তার কতটুকুই বা জানি, দেখতে পারি, কিন্তু ভাবি এই নির্জন রুক্ষ পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে একদল মানুষ কোন এক অদ্ভুত নেশায় গড়ে গেছে এই অতিকায় প্রাণীর অবয়বগুলো। কি ছিল তাঁদের প্রেরণা, যে প্রানীকে কেউই দেখে নি, শুধু মাত্র অনুমান ও কল্পনা দিয়েই যাকে দেখতে হয়েছে, তবুও এক আশ্চর্য ভাবে, অদ্ভুত প্যাশনে এরা তৈরি করেছে এই অতিকায় স্ট্যাচু – কে দেখবে, কে আসবে এই জঙ্গলে, এই কথা তৈরি করার সময় হয়তো একবারও ভাবে নি। দিনে রাতের পরিশ্রমে ওরা সৃষ্টি করে গেছে এই অদ্ভুত প্রাণীর মূর্তিগুলোকে, তারা হয়তো ছিল সৃষ্টির এক অদ্ভুত আনন্দে মগ্ন। প্রাগৈতিহাসিক সময়ের সেই অতিকায় প্রাণীর এই কাল্পনিক মূর্তি গুলোর কাছে সেই নিমগ্ন শিল্পী, সেই নিমগ্ন বিজ্ঞানীর একান্ত, নিমগ্ন, মনোযোগী অধ্যবসায়ের প্রেরণা নিয়ে ফিরি। চলার পথে জীবনের কাছে সেই মানবিক গুণ গুলোকে আরও ভালো ভাবে ধারণ করার প্রতিজ্ঞা করি।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel and tagged , , , , , , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান