ইউরোপে হিচ হাইকিং নিয়ে নানা রকমের ভয়ানক গল্প প্রচলিত আছে। অনেক সময় হিচ হাইকিং করে ডাকাতি কিংবা খুন হয়। হয়তো দু’ জন শান্ত চেহারার লোক গাড়িতে উঠে পিস্তল দেখিয়ে গাড়িটাই নিয়ে নিল কিংবা ডাকাতের গাড়িতেই দু’জন ভালো মানুষ হিচ হাইকারের সর্বস্ব লুট হয়ে গেল। অথবা, যে কোন পক্ষের খুনও হতে পারে।
হাই ওয়ে দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে কোন এক সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলারকে ভুল করে লিফট দিয়ে বিপদে পড়ার ঘটনা নিয়ে তো সিনেমাও হয়েছে। তাই, চট করে হিচ হাইকারদের কেউ লিফট দিতে চায় না। তবুও তো ইউরোপে হিচ হাইকিং বেআইনি নয়, আমেরিকার কোথাও কোথাও শুনেছি হিচ হাইকিং রীতিমত বেআইনি। আবার নেদারল্যান্ডে তো হিচ হাইকারদের জন্যে স্ট্যান্ড করে দেওয়া আছে, যেখান থেকে হিচ হাইকিং এর লিফট পেতে সুবিধা হবে।
যাইহোক, আশা রাখি সুহৃদয় কেউ নিশ্চয়ই আমাদের মতো ভালোমানুষ গোছের মানুষকে রাভেল পর্যন্ত লিফট দেবে। শেষ পর্যন্ত এক ভদ্রলোক আমাদের একদম সামনেই গাড়ি থামালেন। জিজ্ঞেস করলেন – ইন্ডিয়ান? কোথায় যেতে চাও? বললাম – হ্যাঁ। তুলুস।
আমি তো ঐ দিকে যাচ্ছি না, তোমাদের রাভেলে নিয়ে তুলুস যাওয়ার রাস্তায় ছেড়ে দেব, সেখানে বুড়ো আঙ্গুল ব্যবহার করে চলে যেতে পারো তুলুসে –সপ্রতিভ মধ্যবয়স্ক ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোকটি হেসে বললেন।
তাই সই – চট করে চেপে পড়লাম।
ভদ্রলোক পরিবারের সঙ্গে ব্ল্যাক মাউন্টেনের জঙ্গলে একমাসের জন্যে ক্যাম্পিং করছেন। রাভেল চলেছেন বাজার করে আনতে, বললেন – আশেপাশে তো কিছুই পাওয়া যায় না।
গাড়ির স্টিয়ারিঙে রাখা ওনার ডান হাতে দেখি ‘ওঁ’ চিহ্নের উল্কি আঁকা। জিজ্ঞেস করলাম – এই চিহ্ন কি করে আঁকলেন আপনার হাতে?
রাস্তার দিকে চোখ রেখে উত্তর দিলেন সপ্রতিভ ভদ্রলোক – আগের বছর সামারে রাজস্থান গিয়েছিলাম সপরিবারে। সেই সময়েই এই ট্যাটু এঁকেছি।
ভারতবর্ষ নিয়ে এ কথা সে কথা বলতে বলতে রাভেল পৌঁছে গেলাম। রাভেলে তুলুস যাওয়ার রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে – অফ্ বা, বলে চলে গেলেন ভদ্রলোক।
আবার একের পর এক গাড়িকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলেছি। কেউ কেউ তো আমাদের সামনেই অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হেসে হাতের ইশারা দিয়ে দেখাচ্ছে, যেন এই রাস্তায় গেলে আমাদের লিফট দিত। যখন লিফট পাওয়ার আশা একদম নিরাশায় বদলে গিয়ে রাভেলে হোটেল খোঁজার দিকে পা বাড়াচ্ছি, ক্যাঁ…চ শব্দ করে আমাদের থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে বিশাল এক ভ্যান থামল। অল্প বয়সী স্বামী স্ত্রী সামনের সীটে বসে, গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল – কোথায় যাবে?
বললাম – তুলুস।
স্ত্রী হেসে মাথা নেড়ে – ‘উঁহু আমরা তো ঐ দিকে যাচ্ছি না। তবে… ’ বলতে বলতে গাড়ির সামনে রাখা মোটা ম্যাপের বই খুলে দেখাল, ম্যাপে হাত রেখে বলল – এখন আমরা এখানে, এই রাস্তা ধরে আমরা কাস্তালনেদাড়ির পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাব অন্য দিকে, তুলুস তো আমাদের রাস্তার অন্য দিকে। এই অঞ্চলের একটু বড় শহর কাস্তালনেদারি।
বিপদে পড়লে অনেক সময় বুদ্ধির ছিপি চট করে খুলে যায়। তাড়াতাড়ি করে বললাম – আচ্ছা ওখানে তো ট্রেন ষ্টেশন আছে?
স্টিয়ারিঙে বসা ভদ্রলোক বলল – হ্যাঁ। ম্যাপে তো দেখাচ্ছে।
ঠিক আছে, আমাদের কাস্তালনেদারি ট্রেন ষ্টেশনের সামনেই ছেড়ে দিন। ট্রেনে ফিরে যেতে পারবো তুলুস।
গাড়িতে বসে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। প্রচণ্ড তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। গাড়ির ভেতরে রাখা বোতলের গরম জলেই তেষ্টা মিটিয়ে নিয়ে একটু আলাপচারিতা শুরু করলাম।
সামারে ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইউরোপের নানা দিকে। এবার ওরা স্পেন আর ফ্রান্সের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলল – আমরা আসলে গাড়িতে করেই ফ্রান্সের বহু গ্রাম শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ফ্রান্স স্পেনের নানান জায়গায় গিয়ে স্থানীয় বাজারে কাপড় বিক্রির ব্যবসা আমাদের।
ছুটন্ত গাড়ির দু’পাশে সরে যাচ্ছে দক্ষিণ ফ্রান্সের অপরূপ প্রকৃতির সৌন্দর্য। দক্ষিন ফ্রান্সে এই সময়ে রাস্তার দু’পাশের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে সূর্য মুখী ফুল ফোটে। ঝলমলে দিনে নীল আকাশের নীচে সেই অপূর্ব হলুদ চাদর যে কি অপূর্ব ছবি তৈরি করে নিজের চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাসই হতো না।
নীল সন্ধ্যার মুখে কাস্তালনেদারি রেলষ্টেশনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে হাসি মুখে হাত নেড়ে চলে গেল দম্পতিরা। অবশ্য বার বার বলছিল – তোমাদের আমরা তুলুস যাওয়ার রাস্তায় নামিয়ে দিলে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আবার লিফট পেতে পারো।
কিন্তু, রাতের গাঢ় অন্ধকার হতে আর দেরি নেই। বিদেশ বিভূঁইয়ে আর ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। ষ্টেশনে পরের ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করাই ভালো।
কতো অল্প সময়ের পথের এই আলাপ, হয়তো দ্বিতীয় বার ভিড়ের মাঝে দেখলে আর চিনতেও পারবো না, কিন্তু আমার জীবনে সেই অচেনা বিদেশী মানুষগুলোর অবদান এক বিন্দু হলেও রয়ে গেল। মনে হয়, সেই মানুষ গুলোর নিঃস্বার্থ সাহায্য, সহযোগিতা পেয়ে আমার প্রবাসী জীবন যেন অনেক সরল হয়েছে। আমার জীবন স্মৃতির কোন এক পাতায় সেই বিদেশী, অচেনা, ঝাপসা কিছু সুখী মানুষের হাসি মুখের ছবি আঁকা হয়ে যায়। এই পৃথিবীর বুকে অপূর্ব প্রকৃতির কোলে সেই সুখী সংবেদনশীল মানুষদের কথা মনে এলে ভালোই লাগে।
please follow my blog
http://trendingandintresting.wordpress.com
খুব ভালো লাগল,। আমি যেটা শুনেছি যে ফ্রান্স এর এই অঞ্চলে হিচ করে যেতে গিয়ে ছিনতাইবাজ বা অন্য প্রকার ঝামেলাতে পড়তে হয়েছে। শেষের টা বুঝে নিন। কাজেই একটু চোখ কান খোলা রাখবেন। লেখা কিন্তু দারুন হচ্ছে।
ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আমিও শুনেছি তাই তো বেশ ভয় লাগছিল। শুধু ফ্রান্সে কেন, জার্মানিরও অনেক জায়গায় হিচ হাইকিং বিপজ্জনক হয় শুনেছি। কিন্তু, দক্ষিণ ফ্রান্সের এই দিকটা খুবই ভালো। শান্তি প্রিয়, ভদ্র ও বড়লোক মানুষের বসবাস এই দিকে। বাড়ী গুলো দেখলেই বোঝা যায় এদের আর্থিক বল প্রচুর। তাই এই ঝুঁকি নিতে পারলাম।