মাঝ সেপ্টেম্বরের রাত এগারোটা। একদম অচেনা নতুন শহর এই ব্রাতিস্লাভা, কয়েক ঘণ্টা হল এখানে এসেছি। সঙ্গে কোন ম্যাপ নেই। যে হোটেলে উঠেছি সেই হোটেলের নামটিও সঠিক মনে নেই, হোটেলের কোন কার্ড সঙ্গে নেই। যে বাসে হোটেল থেকে শহরকেন্দ্রে এসেছি সেই বাসও বন্ধ হয়ে গেছে, অন্য বাস কোন দিকের ধরব সেও জানা নেই। সম্পূর্ণ ভাবে পথ গেছে ঘুলিয়ে, অনেকক্ষণ ধরে শহরকেন্দ্রের গোলকধাঁধায় ঘুরছি। এই অবস্থায় ‘পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি’ – গানের কলিটি গাওয়া মাত্র সঙ্গীটি রাগে চিরবিরিয়ে উঠল। ‘মজা নয়, উই আর ইন দেঞ্জার। হয়তো আজ সারারাত এই ভাবেই ঘুরতে হবে’। কখনো কখনো নিতান্তই বিবেচক ও সাবধানী ও অবিবেচকের কাজ করে ফেলে। আমরা যে এমন ভাবে অচেনা শহরে রাস্তা ভুলে যাব কখনই ভাবি নি।
এই দেশের নতুন শহরে বিকেলের দিকে পৌঁছেছি, রাস্তায় খুব একটা লোকজন বিকেল থেকেই নজরে আসছে না। তাড়াহুড়ো করে হোটেলে পৌঁছেই মুখ চোখে জল দিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। শহরের কেন্দ্রে পৌঁছেই দূরে পাহাড়ের উপরে নজরে এসেছিল – ব্রাতিস্লাভা ক্যাসল। ট্রামে করে ক্যাসলের একদম দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। এতো নির্জন যে ক্যাসলের ঢোকার মুখ কোনদিকে জানার জন্য কাউকে জিজ্ঞেস করার কেউই নেই, তাই অনেকক্ষণ ক্যাসলের আশেপাশেই ঘুরে দেখতে দেখতে এক ভদ্রলোককে সাইকেল ঠেলে ঠেলে ক্যাসলের দিকে আসতে দেখে তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম।
এই অঞ্চলে বোধহয় টুরিস্ট খুব একটা আসে না। কিংবা এলেও বিকেলের দিকে বোধহয় আসে না। বিদেশী কেউ ওদের দেশ দেখতে এসেছে, এটা দেখেই ওরা অনেক খুশী। হাসিমুখে জানাল কোন দিকে ক্যাসলের মুখ, কোন দিকে গেলে ব্রাতিস্লাভার সবচেয়ে ভালো দৃশ্য দেখা যাবে জানাল। শুধু যে জানাল তা নয় সঙ্গে এসে দেখিয়ে দিল। সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এসেছি শুনে যেন আরও খুশী হল। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা নিজের পরিচিত গন্ডির বাইরে কোনোদিনও যায় নি, নিতান্তই সংসারী, কাজ থেকে ফিরে নিজের ছোট্ট সংসারে ফিরতেই ভালোবাসে। কিন্তু, কোন এক পথিকের মুখে সুদূর দেশের কথা শুনতে ভালোবাসে – ভদ্রলোককে দেখে তাই মনে হল। আমাদের রাস্তা দেখিয়ে হাসিমুখে চলে গেল নিজের পথে।
ক্যাসলের ধরণটা একটু অন্যরকম। উপরে এসে ব্রাতিস্লাভা শহরের সম্পূর্ণ দৃশ্য দেখা যায়। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে দানিয়ুব। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে রঙ ছড়িয়েছে। ক্যাসলের অন্য দিকে এক সরু রাস্তা শহরের দিকে চলে গেছে, শহর কেন্দ্রের দিকে হেঁটে যাওয়ার জন্যে সেই রাস্তা ধরেই হাঁটতে লাগলাম। যেহেতু বিকেলের দিকে পৌঁছেছি, কোন টুরিস্ট ইনফরমেশন অফিস খোলা নেই। তাই নিজেদেরই দেখে নিতে হবে। তবে এই শহরের সমস্ত রাস্তা গুলোতে দেখছি সুন্দর করে দিক নির্দেশ দেওয়া আছে।
শহরকেন্দ্রে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। প্রথমে তো একে ওকে জিজ্ঞেস করে বাস স্টপে পৌঁছে গেলাম। বাস স্টপেও দেখি লোক নেই। কাকে জিজ্ঞেস করবো যে পঞ্চাশ নম্বর বাস কোন দিক থেকে ছাড়ে? অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও বাসের দেখা নেই। এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলাকে অন্য দিকের বাস স্টপে বাসের অপেক্ষা করতে দেখলাম। অগত্যা ওনাকেই জিজ্ঞেস করলাম। উনি জানালেন – এই লাইনের বাস তো বন্ধ হয়ে গেছে। তোমরা কোথায় যাবে?
‘হোটেল ব্রাতিস্লাভা’ আমাদের উদ্বিগ্ন উত্তর।
‘হোটেল ব্রাতিস্লাভা? আমি যতদূর জানি ঐ হোটেল অন্য দিকে।’ – ভদ্রমহিলা বললেন।
‘কিন্তু আমরা তো ইন্তারন্যাশলান বাস স্টপ থেকে পঞ্চাশ নম্বর বাস ধরে তিন নম্বর স্টপে নেমেছিলাম। আর সেখানেই হোটেল।’ – আমরা জানালাম
‘হোটেলের কোন কার্ড বা ফোন নম্বর আছে? আমি ফোন করে জানতে পারি’ – ভদ্রমহিলা সাহায্য করতে চাইলেন।
‘না নেই’ – খুবই হতাশ ভাবে জানালাম।
‘হুম’ – ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন। একটু ভাবলেন। পরে বললেন – ‘তোমরা যে জায়গার কথা বলছ, সেখানে অন্য এক বাস ধরে যেতে পারো। সেখানে গেলে চিনতে পারবে তো?’
আমাদের মাত্র কয়েক ঘণ্টা হয়েছে এই শহরে, তাও আবার রাত হয়েছে, একটু আশঙ্কা ভরে মাথা নাড়লাম – হু, হয়তো পারবো।
সামনে এক বাস আসা মাত্র ভদ্রমহিলা বললেন ‘এটাতেই চেপে পড়’। আমরা যেন মন্ত্র মুগ্ধ, কি করবো নিজেদেরই জানা নেই। চেপে পড়লাম, জানি না এই বাস কোথায় যায়, কোথায় নামবো। দেখি উনিও চাপছেন। কষ্ট করে একটু হেসে বললাম – আপনিও বুঝি ঐ দিকে যাচ্ছেন?
ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন – না, তোমাদের রাস্তা দেখাতে যাচ্ছি।
অবাক আমরা, এও হতে পারে? এই বিদেশ বিভূঁইয়ে দুই বিদেশিকে সাহায্য করার জন্যে নিজের বাস ছেড়ে, নিজের সময় নষ্ট করে অন্য বাসে চেপে অন্য দিকে যাওয়া? কয়েক স্টপ যাওয়ার পরেই বললেন – এখানে নামতে হবে।
আমরা কিচ্ছু জানি না, নেমে পড়লাম ওনার পিছু পিছু। তারপর উনি আমাদের এ গলি, সে গলি দিয়ে এক খোলা মত জায়গায় নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন – এই সেই জায়গা?
চারিদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখে নিয়ে বললাম – না, এ তো সে জায়গা নয়।
উনি বললেন – ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস স্টপ থেকে পঞ্চাশের তিন নম্বর স্টপের কাছেই তো এই জায়গা। তোমরা শিয়র যে তোমরা হোটেল ব্রাতিস্লাভাতেই উঠেছ? কারণ আমি জানি না এখানে কোন হোটেল ঐ নামে আছে।’ ওনার গলায় একটু সন্দেহের সুর ঝরে পড়ল। কে জানে বাবা, বিদেশী মানুষরা আমাকে ঠকিয়ে আমার জিনিস পত্র কেড়ে নেবে না তো? উনি হয়তো ভাবলেন। এই রাতে বিদেশ বিভূঁইয়ে সত্যি কে কাকে বিশ্বাস করবে? আমরাও একটু ভয় পেলাম।
আমি বললাম – পঞ্চাশের বাস স্টপটা কোথায়?
উনি বললেন – ‘চল, ঐ তো কাছেই।’ কয়েক পা হেঁটে পঞ্চাশ নম্বর বাস স্টপেজের সামনে এসে উনি হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন – ‘ঐ দিক দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল বাস স্টপ থেকে পঞ্চাশ নম্বর বাস আসে।’
এতো কাছে পৌঁছেও যেন আমাদের দিগভ্রম হচ্ছে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না হোটেল কোনদিকে? হঠাৎ একটু দূরে এক সবুজ আলোর জ্বলা নেবা দেখে এক ঝটকায় বুঝে গেলাম, ঐ তো হোটেল। ঐ সবুজ আলোর পাশ দিয়েই তো এসেছিলাম। ধড়ে যেন প্রান এলো। ভদ্রমহিলাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেসে বললেন – তাহলে আমি এবার নিজের দিকে যাই।
কি বলে যে ওনাকে ধন্যবাদ জানাব বুঝে পেলাম না। ঠিক যেমন করে হঠাৎ শহরের বাস স্টপে দেখা দিয়েছিলেন তেমনি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে, উনি যে মানুষ, অশরীরী কিংবা কোন দৈবী নন সেই প্রমান নিজের কাছে রাখতে আমি বললাম –‘আপনার একটা ফটো তুলতে পারি?’ উনি একটু হেসে বললেন নিশ্চয়ই।
পরেরদিন দিন সারাদিন এই ছোট্ট শহরে ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল হয়তো বা সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হতে পারে। কিন্তু পেলাম না।
কখনো কখনো পথের এই ধরণের ঘটনা জীবনের এক গল্প হয়ে থেকে যায়, ক্ষণিকের আলাপ চিরস্থায়ী ছাপ ছেড়ে যায়। যখনই ব্রাতিস্লাভা বেড়ানোর গল্প হয় সর্বদাই ঐ ভদ্রমহিলার কথা তো ঘুরে ফিরে আসেই।
puro tan tan uttejona ….. apnar lekha porchilam ar bhabchilam apni hotel pouchate parben ki parben na …… darun obhiggota ……… Bratislava-y lokera ki english-e sachhondo? ….
thank you for liking it….haan East europer e pray sab desh-gulotei motamuti english-e kaj chaliye newa jai……particularly capital city gulote anekei english bojhe…