Toulouse, France
“Come quickly, I am drinking the stars!” – Dom Pierre Perignon
খাঁটি ফ্রেঞ্চরা ওয়াইনের বোতল খুলে গোল গ্লাসে ঢেলে একটু গোল করে নাড়িয়ে নিয়ে ভালো করে দেখে, নাকের সামনে ধরে, চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস নেয়। গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারে ওয়াইনটি ভালো না মন্দ। এক চুমুক ওয়াইন নিয়ে একটু কুলকুচির মতো করে আরও ভালো করে বলে দিতে পারে ওয়াইনের কোয়ালিটি কেমন – কত সালে তৈরি, কখন আঙুর তোলা হয়েছিল, সেই বছর রোদ কেমন উঠেছিল মানে আঙুর ক্ষেতে কত রোদ পড়েছিল এবং কোন সময়ে সেই আঙুর রস ওয়াইন হয়ে বোতল জাত হয়েছিল অবশেষে সেই ওয়াইন কোন ধরণের কাঠের পিপেতে রাখা হয়েছিল – অক কাঠের পিপে না অন্য – এই সব জ্ঞ্যান নিমেষে বলে দিতে পারে। কেউ কেউ তো আবার কোন বাগানের আঙুর থেকে তাঁর হাতের গ্লাসের ওয়াইন তৈরি হয়েছে সেটাও বলে দিতে পারে।
মোটকথা, প্রকৃত ফ্রেঞ্চরা ওয়াইনকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করে। ওয়াইনের স্বাদ- মিষ্টতা বা তিক্ততা, গন্ধ, স্পর্শ, রঙ, স্বচ্ছতা সবই ফ্রেঞ্চ অহংকার, ফ্রেঞ্চ রোমান্স। ফ্রান্সের মানুষের কাছে এক ওয়াইনের বোতল মানে রোমান্স। ফ্রান্সে মোটামুটি সবাই প্রায় ওয়াইন বিশেষজ্ঞ। তবে কোন কোন বিদেশীরাও কিছুদিনের মধ্যেই বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে, তবে তাঁর জন্যে বহু কাঠ খড় পোড়াতে হয়। এতো আর পুঁথিগত বিদ্যা নয়। প্রচুর অভিজ্ঞতা চাই।
বছরের নানা সময়ে তুলুসের আশেপাশের নানান vineyard এ ওয়াইন টেস্টিং উৎসব হয়। সেই vineyard এর ওয়াইন বাজারজাত হওয়ার আগে সেই টেস্টিং উৎসবে সবাইকে খোলা নিমন্ত্রণ জানায়। এই উৎসবের উদ্দ্যেশ্য শুধু ওয়াইন টেস্টিং ও কেনা নয়, খোলা গাড়িতে করে পুরো আঙুর ক্ষেত, ওয়াইনের কেভ ঘুরিয়ে দেখানো হয়– ওয়াইন ট্যুর হয়। মাটির নীচের ঘরে সারি সারি র্যাকের মধ্যে ওয়াইন বোতল গুলোকে অতি সযত্নে শুইয়ে রাখা হয়।
শহর থেকে একটু দূরে গ্রামের দিকের সেই vineyard দেখার সুযোগ যখন এলো হাতছাড়া করি কি করে? শনিবারের উজ্জ্বল ছুটির দিনে ঘরে বসার চেয়ে সবুজ আঙুর ক্ষেত ঘুরে দেখা হাজার গুণ ভালো। শতাব্দী প্রাচীন বড় বড় ওয়াইন কেভে কত সযত্নে প্রাকৃতিক উপায়ে কি ভাবে ওয়াইন তৈরি হয় ও রাখা হয় – সেটা দেখার নিমন্ত্রণ এড়ানো যায় না।
কত প্রকারের, কত রঙের আঙুর থেকে যে রেড ও হোয়াইট ওয়াইন তৈরি হয় তার ইয়ত্তা নেই। অনেকেই ওয়াইনকে এলকোহলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে, কিন্তু ওয়াইন সোজা ভাষায় fermented আঙুর রস, এলকোহলের মাত্রা খুবই কম। লাল ওয়াইন তৈরি হয় কালো ‘Pinot noir’এবং ঘন নীল ‘Merlot’ ও অন্যান্য আরও কালো প্রজাতির আঙুর থেকে। সাদা ওয়াইন তৈরি হয় নানান প্রজাতির সাদা আঙুর থেকে। তুলুসের পাশের আঙুর ক্ষেত গুলোতে ‘Mauzac’ প্রজাতির সাদা আঙুরের চাষ হয়। এই প্রজাতির আঙুর থেকে সাদা sparkling wine ও তৈরি হয়। তাছাড়া এদিকে কিছু ‘Muscats’ প্রজাতির সাদা আঙুর ও চাষ হয়। ওয়াইন তৈরির নানান পদ্ধতিতে ওয়াইনের স্বাদ ও গন্ধ নাকি বদলে যায়। নানান ধরণের ওয়াইন তৈরির পাত্রের জন্যও নাকি ওয়াইনের স্বাদ গন্ধ বদলে যায়। অনেক প্রজাতির আঙুর মিলিয়েও কোন বিশেষ দামী ওয়াইন তৈরি হয়। ফ্রান্সের ওয়াইন তৈরির ইতিহাস প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। ফ্রান্সের কোন কোন অঞ্চলের ওয়াইন আবার পৃথিবী জোড়া নাম করেছে। যেমন ফ্রান্সের Bordeaux অঞ্চলের ওয়াইন মানেই নিঃসন্দেহে ভালো। তাছাড়া তুলুস থেকে কিছু দূরে Gaillac অঞ্চলের ওয়াইনও খুব ভালো। বহু বার এই অঞ্চলের ওয়াইন সোনা জিতেছে। প্রতি বছর নানান বাগানের ওয়াইনের প্রতিযোগিতা হয়। সেই প্রতিযোগিতায় নানান ওয়াইন সোনা, প্লাটিনাম ইত্যাদি জেতে ও বাজারের সেইসব ওয়াইন নিজের সংগ্রহে রাখার জন্যে ফ্রেঞ্চ বাসীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
ফ্রান্সের ওয়াইন অঞ্চলের প্রায় সবাই ধনী। বিশেষ করে শ্যাম্পেন অঞ্চলের লোকেরা। ফ্রেঞ্চ শ্যাম্পেন মানে sparkling wine শুধু মাত্র ফ্রান্সের বিশেষ অঞ্চল থেকেই উৎপন্ন হয়। ফ্রান্সের লোকের কাছে সে এক গর্বের বিষয়। পনেরো শতকে আকস্মিক ভাবে এই sparkling wine এর জন্ম, তারপর তো জগত জোড়া নাম করেছে বহু শতাব্দী ধরে।
পুরনো চাল যেমন ভাতে বাড়ে, তেমনি পুরনো ওয়াইন দামে বাড়ে। সব ওয়াইন আবার পুরনো হতে পারে না, শুধুমাত্র ভালো জাতের ওয়াইনই পুরনো হয়েও ভালো থাকে, নয়তো খারাপ হয়ে যায়। সে এক রহস্য, শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞরাই সেই রহস্যের সমাধান জানে। এক এক ওয়াইনের বোতল শুধু মাত্র বোতল নয় – এ এক অহংকার, এক স্বপ্ন, এক সাধনা, এক গহন রোমান্স। যে রোমান্সে ফ্রেঞ্চরা আদ্যপান্ত ডুবে আছে।
যাইহোক, চৈত্রের কোন এক উদাসীন সন্ধ্যায় বা শীতের জড় বিকেলে ফ্রান্সের তরল রোমান্স – শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আদি ফ্রেঞ্চরা Dom Pierre Perignon এর মত বলে ওঠে “Come quickly, I am drinking the stars!”