July 2012, Camping Montrose, France
জুলাইয়ের দুরন্ত গরমে দক্ষিণ ফ্রান্সের শান্ত, নির্জন, সবুজ কোন এক গ্রামের ঝলমলে সোনালি সকাল, হাজার পাখির কূজন, সকালে ফেঞ্চ ব্রেড ও কফি দিয়ে প্রাতঃরাশ, রোদ্র উজ্জ্বল দিন, ফুরফুরে বাতাস, নীল আকাশ যেখানে নীল মেডিটেরিয়ান সমুদ্রে দিগন্তে মিশেছে – ভাবলেই যেন মনে হয় স্বপ্নের দিন, নিজের অজান্তেই মুখে এক মুচকি হাসি ফোটে, গরমের দাবদাহ যেন এক নিমেষেই উবে যায়।
গরমের সময় তাই এখানে অনেকেই সেই গ্রামীণ, প্রাকৃতিক, সহজ, সরল ফ্রেঞ্চ সকালের খোঁজে পাড়ি দেয় দক্ষিণ ফ্রান্সের নানা দিকে। কখনো জঙ্গলে, কখনো মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের ধারে, কখনো বা দিগন্ত বিস্তৃত আঙুর ক্ষেতে পাড়ি জমায়, ক্যাম্পিং করে। পাহাড় জঙ্গলের পথে হাইকিং-এ যায়। শহরের মানুষ কয়েকদিনের জন্যে অনুভব করে নেয় আদিম গ্রাম্য ফ্রেঞ্চ জীবন।
দক্ষিণ ফ্রান্সে অনেক ক্যাম্পিং সাইট আছে। তাই প্রচুর টুরিস্ট ইউরোপের নানা দিক থেকে এদিকে পাড়ি দেয়। এখানের মানুষ প্রকৃতির হাতছানি এড়িয়ে ঘরে থাকতে পারে না।
এক গরমের ছুটিতে ঠিক হল এবার তাহলে ক্যাম্পিং এ যাওয়া হোক। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুক্র বারের বিকেলে চারজন বেড়িয়ে পড়লাম। জুলাইয়ের এ সময়ে ক্যাম্পিং সাইট খালি পাওয়া খুব মুশকিল। ইন্টারনেটে অনেক খুঁজে পেতে মেডিটেরিয়ান সমুদ্র বন্দর সেট (Sete) নামে এক জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল এক ক্যাম্পিং সাইট ‘Camping Montrose’ । ফ্রান্সের গ্রামের এই সমস্ত ক্যাম্পিং সাইট গুলোতে আধুনিক সমস্ত সুযোগ সুবিধা বর্তমান। শুধু নিজেদের তাঁবু নিয়ে যেতে হয়। অনেকে ক্যারাভ্যান নিয়েও আসে এখানে। আবার কাঠের তৈরি ছোট ছোট কটেজও ভাড়া পাওয়া যায়। অনেকে আবার এখানে প্রকৃতির কাছাকাছি এক দু’মাস ক্যাম্পিং এ কাটায়। পুরনো প্রথায় চিঠি লেখে আত্মীয়দের। সকালে ডাক হরকরা এসে সেই চিঠি সংগ্রহ করে, চিঠি থাকলে দিয়েও যায়। আজকের ইন্টারনেট-ইমেলের দিনে অনেকটা সেই ভুলে যাওয়া দিনগুলোকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা।
তুলুস থেকে অনেকদূর ঠিক রাস্তা ধরেই চলেছিলাম। কিন্তু, সন্ধ্যা নামার আগেই রাস্তা গেল ঘুলিয়ে, ভুল পথে যাওয়ার জন্যে জি পি এস ও উলটো রাস্তা দেখাতে শুরু করল। রাস্তার দু’ধারে দিগন্ত বিস্তৃত চাষের জমি। সন্ধ্যা নামা মাত্র গভীর অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারিধার। শহর ছাড়িয়ে এসেছি অনেকক্ষণ। তাই, এদিকে হাই ওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচল ও অনেক কম।
তাছাড়া, এই সময়ে ফ্রান্সের হাইওয়েতে রাস্তা গুলিয়ে গেলে জিজ্ঞেস করার মত কাউকে দেখাও যায় না। গাড়ি গুলো হুঁশ হুঁশ করে পেরিয়ে যায়। অনেক ঘুরে রাত প্রায় বারোটার দিকে পৌঁছলাম ক্যাম্পিং সাইটে। রাতে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিন দিক দিয়ে জঙ্গল-ঝোপ ঘেরা ক্যাম্প করার সমতল, পরিষ্কার জায়গা দেখিয়ে দিল কেয়ার টেকার। ক্যাম্প খাটিয়ে নিয়ে শুতে শুতে অনেক রাত হয়েছিল। এখানে রাত জঙ্গলের আওয়াজে সরব।
ভোর হতেই হাজার পাখির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোথায় এলাম? চারিদিকে যতদূর চোখ যায় সবুজ আঙুর ক্ষেত। এই ক্যাম্পিং সাইট পঞ্চাশ হেক্টর আঙুর ক্ষেতের মাঝে। মে থেকে সেপ্টেম্বর – এই সময়েই এখানে লোক সমাগম হয়। এই ওয়াইন বাগান প্রায় একশো বছর পুরনো। দূরে পাকা আঙুর তোলার মেশিন আঙুর তুলে চলেছে। সকালের রোদ চড়ার আগেই নাকি আঙুর তুলে ওয়াইন ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে দিতে হবে। আঙুর ক্ষেতের ওপাশেই আছে গ্রাম।
কি সুন্দর, নির্মল এক গ্রামীণ সকাল। হাঁটতে হাঁটতে প্রাতঃরাশের জন্যে গ্রাম থেকে ফ্রেঞ্চ ব্রেড নিয়ে এলাম। ফ্রেঞ্চ স্টাইলে এক শান্ত দিনের শুরু হল। সারা দিন আজ সমুদ্রের ধারে কাটবে।
এখানে নির্জন রাত নামে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে। জঙ্গল ঘেরা জায়গায়, খোলা আকাশের নীচে, ক্যাম্পের পাশে আমরা কয়লার আগুন জ্বালিয়ে রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত। এই সময় মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের ধারের শহরে প্রচুর সারডিন মাছ পাওয়া যায়। কয়লার আগুনে সেই সারডিন মাছ পুড়িয়ে খেতে খুব সুস্বাদু। সেই পোড়া কয়লার গন্ধ যুক্ত সারডিন মাছের স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। কোন কোন পরিবেশের সঙ্গে কোন এক বিশেষ গন্ধ ও বিশেষ স্বাদ যেন জড়িয়ে থাকে। জীবনে আর কখনোই সেই স্বাদ, গন্ধের পুনরাবৃত্তি হয় না বা করা যায় না।
নির্জন আঙ্গুর ক্ষেতে নিকষ কালো অন্ধকার রাতে আকাশ ভরা তারা – আমাদের যেন নিয়ে গেছে অতীত দিনে। মাঝে মাঝে দূরে কোন এক গাড়ির হেড লাইট মনে করিয়ে দিচ্ছে – না সভ্যতা থেকে আমরা খুব দূরে নেই। প্রকৃতির খুব কাছে কিছুদিনের এই ছুটি যেন মানসিক ভাবে সতেজ করে তোলে। নগর জীবনের ধোঁয়াশা যেন প্রকৃতি এক নিমেষে ধুয়ে দেয়।