আন্তর্জাতিক ভাষা উৎসব (Forom des langues du monde, Toulouse)

Toulouse, France

সারা বিশ্বের ভাষা প্রতিবছরের মে মাসের শেষ রবিবারে তুলুসের ক্যাপিটল চত্তরে জমায়িত হয়। এই ভাষা উৎসবে সমস্ত দেশের ভাষাভাষীদের স্টল বসে। সেই স্টল গুলোর মধ্যে আমাদের দেশের ভাষারও স্টল বসেছে।

এই ভাষা উৎসবের মূল উদ্দ্যেশ্য হল নানান ভাষার বর্ণমালা প্রদর্শন করা, সেই ভাষার গল্প কবিতা, সেই ভাষার কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টির প্রদর্শন করা। শুধু যে গল্প কবিতা তা নয় সেই দেশের সঙ্গীত, নৃত্য, সংস্কৃতির প্রদর্শনও এই ভাষা উৎসবের উদ্দ্যেশ্য।

এই ভাষা উৎসবের পত্তন হয়েছিল ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ ফ্রান্সের  Occitan ভাষা নিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে পৃথিবীর নানান ভাষা যোগ হয়েছে এই মেলায়।

আজ ২০১০ সালে ১০২ টা বিশ্ব ভাষার সম্মেলন হচ্ছে, এর মধ্যে অনেক ভাষা মৃত বা মৃতপ্রায়। এই ভাষা উৎসবের আরেক মূল উদ্দ্যেশ্য হল পৃথিবীর যত মৃত, মৃতপ্রায়, বিলুপ্ত সেই সব ভাষাকে তুলে ধরা। কিছু কিছু ভাষা খুব দ্রুত বিলুপ্তির পথে শক্তিমান ভাষার চাপে, বিশ্বায়নের চাপে এবং তা কিছু মানুষের কথ্য ভাষার মধ্যেই সীমিত আছে সেই সব ভাষা গুলোকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা এর উদ্দ্যেশ্য।

অক্সিটানিস্ট ভাষাবিদ, চিন্তাবিদ এবং লেখক ফেলিক্স কাস্তান প্রথমে ভাবেন অক্সিটান ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আগে সমস্ত পৃথিবীর মৃত বা মৃতপ্রায়, বিলুপ্ত বা বিলুপ্তির আশঙ্কায় ধুঁকছে সেই সব ভাষাকে আগে বাঁচাতে হবে। সেই ভাবনা থেকে তিনি বিশ্বের সমস্ত ভাষাকে এক উৎসবের মধ্যে জমায়িত করার চেষ্টা করেন।

ফেলিক্স কাস্তান অক্সিটান ভাষার লেখক ছিলেন, প্রথমে পেশায় ছিলেন ফার্ম লেবার পরে শিক্ষকতা করেন। অক্সিটান ভাষা ফ্রান্সের দক্ষিণ তৃতীয়াংশে প্রচলিত একটি রোমান ভাষা, ভাষাটি ‘অক’ ভাষা নামেও প্রচলিত। ফ্রান্সের প্রায় এক এক চতুর্থ অংশ জনগন এই ভাষায় কথা বলেন।

১১ শতক থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত এই ভাষায় বহু সাহিত্য রচনা হয়। এই ভাষাটি তখন ফ্রান্সের অনেক উত্তর পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। ১৪ শতকে উত্তর ফ্রান্স দক্ষিণ ফ্রান্সের উপরে আধিপত্য বিস্তার করায় এই অক্সিটান ভাষাটির গুরুত্ব ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে।

১৯ শতকে কবি ফ্রেদেরিক মিস্ত্রাল একটি সাহিত্যিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ফলে এই ভাষাটি একটি আধুনিক সাহিত্যিক ভাষা রূপে প্রতিষ্টিত হয়। আঞ্চলিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে ফ্রেঞ্চ সরকার সরকারী স্কুলে অক্সিটান ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদান শুরু করে।

বর্তমানে অক্সিটান ভাষার উপরে ফ্রেঞ্চ এবং ইতালীয় ভাষার প্রভাব বেশী কিন্তু এর মূল গঠন এখনও স্পেনীয়। এই ভাষা ফ্রান্সের দক্ষিণ অঞ্চলে ও স্পেনের কিছু অংশে, ইতালির কিছু অংশে ও মোনাকোতে প্রচলিত। প্রায় দু’কোটি মানুষ এই ভাষা বলতে ও বুঝতে পারে।

অক্সিটান ভাষা আজ বিপর্যয়ের মুখে অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষার সামনে। প্রথমের দিকে এই মেলায় কিছু ইউরোপীয় ভাষাই জমায়েত হত। ইউরোপের নানান জায়গায় অনেক রকম আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন আছে অথচ তা অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষার চাপে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাছাড়া মানুষ যতই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায় ততই তাঁর কথ্য ভাষায় অন্যান্য জায়গার প্রভাব পড়ে। সেই প্রভাবে এত বেশী প্রভাবিত হতে থাকে যে আসল ভাষাটি ক্রমে হারিয়ে যেতে বসে।

ভাষা বিলুপ্তি আজ সারা পৃথিবীতে। আমাদের সংবিধানে যদিও ২৩ টা ভাষা আছে অথচ আমাদের মূল উদ্দ্যেশ্য ইংরেজি শেখা। নিজের ভাষার সাহিত্য, কবিতাই আমরা জানি না।

আজ ফ্রান্সের মাটিতে আমাদের কাছে কাছে সুযোগ এসেছে নিজেদের কিছু ভাষাকে স্মরণ করার। আজ বিশ্বের ১০২ টা ভাষার মধ্যে আমাদের বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবী, ওড়িয়া, মালায়ালি, তামিল ভাষার স্থান হয়েছে।

আমি পসরা সাজিয়েছি বাংলা ভাষার। আমি যেন আমার ছেলেবেলার গল্পের ঝাঁপি খুলে দিয়েছি আমাদের স্টলে। আবার নতুন করে উপেন্দ্রকিশোর কে মনে করলাম। মনে এলো ‘টুনটুনির বই’ ‘সন্দেশ’। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ ‘গোঁপ চুরি’ ‘কাঠ বুড়ো’ ‘খিচুড়ি’ এই সমস্ত ছড়া ইন্টারনেট ঘেঁটে প্রিন্ট নিয়ে হাজির হয়েছি। মন একছুটে ছোট্টবেলার চিলেকোঠার ঘরে হাজির হয়েছে।

শৈশবে আমরা যে কি পেয়েছি, কি পেয়ে বড় হয়েছি ভাবলে আজ কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায়। জানি না আজকের বাচ্চাদের জীবনে ‘আবোল তাবোল’ আছে কিনা।

‘আয়রে ভোলা খেয়াল খোলা / স্বপন দোলা নাচিয়ে আয়/ আয়রে পাগল আবোল তাবোল/মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়/… আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়/ মন ভেসে যায় কোন সুদূর’- আজকের বাচ্চাদের জীবনে কি কোন সুদূরে মন ভাসিয়ে দেওয়ার সময় আছে? হয়তো নেই। আজকের বাচ্চাদের কাছে কল্পনার পক্ষিরাজকে অনেক দূরে ছুটিয়ে দেওয়ার সময় নেই। কল্পনার দৌড় নেই কিন্তু ইঁদুর দৌড় আছে।

আমাদের স্টলে ফেলুদাও এসেছেন। সত্যজিৎ রায় ও তাঁর ছায়াছবির সঙ্গে ফ্রেঞ্চরা বেশ পরিচিত। সত্যজিত রায়ের ‘টিনটোরেটর যীশু’ বইয়ের ফ্রেঞ্চ অনুবাদ Le Christ de Tintoretto র প্রিন্ট আমাদের স্টলে রাখা হয়েছে। ফ্রেঞ্চরা বেশ উৎসাহের সঙ্গে দেখছে।

রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টির উপরে ফ্রেঞ্চ ভাষায় এক পোস্টার বানিয়ে স্টলে প্রদর্শন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নাটক, কবিতার ফ্রেঞ্চ অনুবাদ অনেক ফ্রেঞ্চরা পড়েছে। এক ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোক জানালেন তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ পড়েছেন, ‘অমল’কে বেশ ভালভাবে চেনেন তিনি।

সারাদিন ধরে পৃথিবীর নানান দেশের সাহিত্যে, কবিতা, গল্প, সঙ্গীত, নৃত্য, ক্যালিগ্রাফি, খাবার আরও কতো কি! দিনটা এক ফুঁয়ে উড়ে গেল আনন্দে, হাসি-কোলাহলে।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel and tagged , , , , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান