তুলুসের ক্রিসমাস বাজারে (Marché de Noël, Toulouse, France)

December 2013, Toulouse, France

দোকানে দোকানে, সুপারমার্কেটে শুরু হয়ে গেছে ক্রিসমাসের জিনিস সাজানো, সমস্ত রাস্তা লাইট দিয়ে সাজানো হয়ে গেছে। শীতের এই সময় সারাদিনের কয়েক ঘণ্টা সূর্য দিগন্তের দিকে একটু হেলে থাকতে থাকতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। কোন কোন দিন আবার ধূসর, সারাদিন ঘন কুয়াশা ঢেকে রাখে চরাচর। দূরের ঘরবাড়ি সব ঝাপসা দেখায়। ঘন নিঝুম জড় শীতে, হাড় হিম ঠাণ্ডায় দোকানের ও রাস্তার ঐ আলো গুলো উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে। বিষণ্ণ শীতের বেলায় ঐ উজ্জ্বল আলো দেখে সত্যি যেন অকারণ আনন্দে আক্রান্ত হই।

বাতাসে ভাসছে ‘Jingle Bell’ গানের সুর। ক্যাপিটল চত্বরে এই ঠাণ্ডায় বসে হাসিমুখে এক বয়স্ক আফ্রিকান লোক দারুন সুরে গিটার বাজিয়ে ‘Jingle Bell’ গান গাইছে। সামনের থালায় কত পয়সা পড়ছে সে দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই শুধু গান শোনানোই যেন ওর উদ্দ্যেশ্য। বছরের নানা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওর গানের সুর বদলায়। এখন ক্রিসমাসের সুর ওর গিটারে। ভালো লাগে এই পরিবেশ।

ডিসেম্বরের শুরুতেই তুলুসের হৃদয় – ক্যাপিটল চত্বরে ‘marché de Noël’ শুরু হয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষের এই বাজার চায়নায় তৈরি জিনিসের আগ্রাসন থেকে যতটুকু পারে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, তাই আঞ্চলিক এই ছোট্ট বাজার ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির ছোট খাট জিনিস দিয়ে সাজানো। কে জানে হয়তো, এই বাজারেও চায়নার জিনিস ক্যামুফ্লেজ করেছে। বিশ্বের খোলা বাজারে উন্নত মানের আলপিন থেকে শুরু করে এরোপ্লেন সবই তো চায়না তৈরি করে।

সে যাই হোক, আলো দিয়ে সাজানো কাঠের তৈরি ছোট ছোট ঘরের মধ্যে এক মাসের এই বাজারে তুলুসবাসির আনন্দের হাট বসে। বাজারে ঢোকার অনেক আগে, দূর থেকে ভেসে আসে কয়লার আগুনে চেস্ট নাট সেঁকার এক মিষ্টি গন্ধ। তীব্র ঠাণ্ডায় পোড়া পোড়া ঐ সুবাসই যেন উষ্ণতার স্পর্শ দেয়। গত পাঁচ বছর ধরে ঐ মিষ্টি গন্ধ আমার কাছে যেন ক্রিসমাস শুরুর সুবাস।

ছোট এই মেলায় ভিড় ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে ‘vin chaud (hot wine)’ দোকানের লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়াই। বিশাল পাত্রে ওয়াইন, দারুচিনি, চিনি, লেবু ইত্যাদি দিয়ে ফুটিয়ে গরম ওয়াইন বিক্রি এই মেলার এক বিশেষ অঙ্গ। এক গ্লাস গরম ওয়াইন নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেলা দেখা – এটাই এই marché de Noël এর কেতা। মিষ্টি এই পানীয় কিন্তু অনায়াসে শীত দূর করে দেয়।

তাছাড়া গরম গরম churros ভাজা, চকোলেট এই সব যেন আমাদের দেশের মেলার গরম জিলিপির বিকল্প।

এই মেলায় সমস্ত ইউরোপ যেন ঝুঁকে পড়ে, সুদূর পূর্ব ইউরোপের খেলনা, ঘর সাজানোর সমস্ত জিনিস এখানে পসার সাজায় প্রতিবছর। প্রতি বছর একই মুখের দেখা পাই বিক্রেতাদের মধ্যে। অনেকটা ঠিক পরিযায়ী পাখিদের মত, শীতের সময় ঠিক চলে আসে বিশেষ এই জায়গায়।

ফ্রান্সের স্থানীয় মানুষের হাতে তৈরি cakes, jams, chocolate তো এই মেলার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাছাড়া, তুলুসের আশেপাশের নানান ফার্ম থেকে উৎপাদিত foie gras, মধু, মধুর চকোলেট দিয়ে সাজানো ছোট ছোট দোকান গুলো যেন মানুষের সেই আদিম পেশার কথা মনে করায় – যখন ‘সুপার মার্কেট’ নামে বিশালাকার বাজার ছিল না, আন্তর্জাতিক বাজার নামে কোন বাজার ছিল না। বিশাল সেই বাজারের আগ্রাসনের হাত থেকে বেঁচে স্থানীয় ব্যাবসাদারের এই ছোট্ট প্রচেষ্টা সত্যি সুন্দর। বেঁচে থাকুক স্থানীয় সংস্কৃতি, স্থানীয় পরিচয়, স্থানীয় মানুষ – না হলে ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’ হবে কি করে।

      

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel and tagged , , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান