ভারসেই প্রাসাদের বাগানে (The Gardens of Versailles, France)

সান কিং লুই XIV র প্রাসাদ তো স্বপ্নপুরীর রূপ পেল, কিন্তু তাঁর বাগানকে যে স্বর্গ কানন তৈরি করতে হবে। ডাক পড়ল সেই সময়ের বিখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্ট ও আর্কিটেক্ট  André Le Nôtre র। যতদূর চোখ যায়, শুধুই জঙ্গল ছিল এই জায়গা – তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সেই জঙ্গলকে বাগানে রূপান্তরিত করা।

পাহাড়ি জল জঙ্গলে ঘেরা সেই জায়গাকে পৃথিবী বিখ্যাত নয়নাভিরাম বাগানে পরিণত করতে যত তাঁর কল্পনার জোর ছিল, ততই ছিল পেশীশক্তির অবদান। হাজার হাজার মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করেছিল এই সুন্দর বাগান তৈরির জন্যে। প্রায় চল্লিশ বছরের পরিশ্রমে এই বাগান স্বর্গ কাননের রূপ পেয়েছে। প্রায় আটশো হেক্টর জমির উপরে তৈরি এই বাগান পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সুন্দর বাগান হিসাবে পরিচিত, তাই ভারসেই প্রাসাদ সহ এই বাগানকে ইউনেস্কো সযত্নে রক্ষা করেছে। আজও প্রতিদিন পৃথিবীর নানা কোন থেকে হাজার হাজার মানুষ সতেরো শতাব্দীর তৈরি এই বাগান দেখতে আসে।

প্রাসাদ থেকে বেরিয়েই জ্যামিতিক নক্সায় ঘাসের আলপনা, সুন্দর করে ছাঁটা সবুজ ঝোপ, রাস্তা, ফুলের আলপনা, ফোয়ারা, অপূর্ব মূর্তি, গ্র্যান্ড ক্যানাল ইত্যাদি যাতে রাজার মন কেড়ে নেয়, সেই দিকে ছিল Le Nôtre র ঘোর মনোযোগ। আর রাজা যখন দিগন্তে চোখ রাখবে – সবুজ দিগন্তের দৃশ্যের বিস্তারে যাতে কোথাও বাধা না মানে। কিংবা, ভারসেই রাজ প্রাসাদের জানালা দিয়ে কাজের ফাঁকে যখনই রাজা বাগানে চোখ রাখবে রাজ কাজের ক্লান্তি যাতে নিমেষে মিলিয়ে যায়।

মোটকথা, সেই জঙ্গলে ঘেরা জায়গার সৌন্দর্য বৃদ্ধির দায়িত্ব ছিল André Le Nôtre উপরে, এখানে এসে বোঝা যায় রাজা সঠিক মানুষকেই দায়িত্ব দিয়েছিল। সেই সময়ে ফ্রান্সে বাগান তৈরির অনেক নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছিল। জ্যামিতিক নক্সায় গাছ লাগানোর এই পদ্ধতি ‘jardin à la française’ ফ্রান্সে তো বিখ্যাত হয়েই ছিল, পুরো ইউরোপে সেই পদ্ধতির অনুকরণ হয়েছিল। বড় বড় গাছ শিকড় সহ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার, সতেরো শতাব্দীর সেই পদ্ধতি আজও ব্যবহার হয় ইউরোপে।

প্রাসাদের বাইরের জ্যামিতিক নক্সার বাগান ছাড়িয়ে দূরে দেখা যায় সারি বাঁধা বড় বড় গাছের সারি। শীতে সমস্ত গাছ শুকনো ডাল মেলে আছে, কিন্তু সেই শুকনো ডালই কি সুন্দর ভাবে ছাঁটা। বিশাল বাগান ঘুরে দেখার জন্যে ছোট্ট টয় ট্রেন আছে।

সেই সময়ের ফ্রেঞ্চ বাগানে ফোয়ারা ছিল ভীষণ জরুরী এক অলংকার। তাই এই প্রাসাদ বাগানে প্রচুর ফোয়ারা বাগানের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে, ডিসেম্বরের শীতে বিখ্যাত ‘Latona’ ফোয়ারা সহ অন্যান্য সমস্ত ফোয়ারার নীচে জল জমে বরফ হয়ে আছে। কিন্তু, সকালের আলোয় ফোয়ারার মূর্তিরা অপূর্ব ছবি তৈরি করেছে। আর শীতে সেই স্তব্ধ ফোয়ারার সৌন্দর্য দেখতেই মানুষের ঢল নেমেছে।

প্রতি বছর সামারের শুরু থেকে অক্টোবরের প্রতি উইক এন্ডে ভারসেই এর সমস্ত ফোয়ারা চালু থাকে, মিউজিক সহ আলোর ফোয়ারা প্রদর্শনী হয়। আজও বহু যত্নে ভারসেই প্রাসাদের বাগানে চাষ হয়, খামারে পোষা হয় গরু, ভেড়া। সতেরো শতাব্দীর বাগানে আজও প্রচুর মানুষ বাগানের কাজে ব্যস্ত, আজও প্রতিটি ঝোপ যত্নের সঙ্গে ছাঁটা হয়, ফুল গাছ লাগানো হয়। সেই সময়ের গ্রামীণ ছবিটি এখনো অমলিন। আর শীতের দুপুরে সেই অমলিন ছবির ফ্রেমেই যেন আমরা হেঁটে চলেছি।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel and tagged , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s