এমিলি পুলের নিয়তি (Le Fabuleux Destin d’Amélie Poulain)

তুলুসে ফ্রেঞ্চ শেখার ক্লাসে সিনেমাটির কয়েক ঝলক দেখে ইচ্ছে হয়েছিল পুরো সিনেমাটি দেখার। রোম্যান্টিক হাস্য রসে ভরপুর এক সহজ সরল ঝরঝরে সিনেমা। অপূর্ব মিউজিক। এমিলির জীবন ও তাকে কেন্দ্র করে পরিবারের লোকের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে এক মজার সিনেমা। অনেক সময় আমাদের জীবনেও প্রতিদিন একই কাজ করে যাই অথচ সেই কাজ থেকেই এক সুন্দর গল্প তৈরি হতে পারে!

এমিলির হার্ট দুর্বল থাকার জন্যে ওর স্কুলে যাওয়া হয় নি, বাড়ীতেই মায়ের কাছে পড়াশোনা করত। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে না মেলা মেশার জন্যে এমিলির একাকী কল্প দুনিয়া তৈরি হয়। ছেলেবেলায় এমিলির বন্ধু ছিল এক গোল্ড ফিশ। বারবার সেই গোল্ড ফিশ জল থেকে লাফিয়ে সুইসাইড করতে চায়, তাই এমিলির বন্ধুটিকে মা জলে ছেড়ে দেয়।

এমিলির জন্যে মা এক ছোট্ট ক্যেমেরা কিনে দেয়। এমিলি যা কিছু দেখে ফটো নিতে থাকে, এক দুপুরে ফটো নিতে গিয়ে চোখের সামনে দুটো গাড়ির ধাক্কা লাগে। প্রতিবেশী একজন ওকে বোঝায় – ফটো তুলেই এই এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেদিন রাতে এমিলি খুব ভয় পায়, টিভির খবরে দেখে শুধুই এক্সিডেন্ট। কিছুদিন পরে ফুটবল খেলার দিনে এমিলি ঠিক করে নেয় ঐ প্রতিবেশিকে সায়েস্তা করতে হবে।

কিছুদিনের মধ্যে এক দুর্ঘটনায় এমিলি তাঁর মাকে হারায়। বাবা, মায়ের স্মৃতি নিয়ে ডুবে থাকে, বাগানে এক ছোট্ট ঘর বানিয়ে মায়ের দেহ ভস্ম রাখে। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে আসে। এমিলি বড় হয়। একদিন ঠিক করে বাড়ী ছেড়ে প্যারিস যাবে ভাগ্য সন্ধ্যানে।

প্যারিসের Montmartre এলাকায় এক রেস্টুরেন্টে ওয়েট্রেসের চাকরি পায়। ছোট্ট ঘরে ভাড়া থাকে, আর চাকরি করে গতানুগতিক ভাবে। সেখানেও এমিলির আশেপাশের মানুষদের দৈনন্দিন ছোট ছোট ভালো মন্দ লাগা গুলোকে দারুন উপায়ে দেখানো হয়েছে। কিছু কিছু ভালো মন্দ লাগা যেন আমাদের ভালো মন্দ লাগার সঙ্গেও মিলে যায়। সময় এমিলির জীবনে কিছুই বদলাতে পারে না, এমিলি একাকী ছিল, এখনো একাকী। একাকিত্ব এমিলিকে ঘিরে আছে।

এক রাতে টিভিতে লেডি ডায়ানার দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতে এমিলির জীবনে এক পরিবর্তন আসে। সেই রাত থেকেই এমিলির জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। এমিলি তাঁর ঘরের দেওয়ালের খোপে বহু পুরনো এক ছোট্ট টিনের বাক্স আবিষ্কার করে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের এক ছোট্ট ছেলের বাক্স, তাঁর ছেলেবেলার ছোট্ট ছোট্ট জিনিসের সঞ্চয় সেই বাক্সে। বাক্স আবিষ্কার একাকী এমিলির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যে প্রথম তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কার করেছিল সেই বুঝতে পারবে এমিলির এই বাক্স আবিষ্কারের রোমাঞ্চ।

ও ঠিক করে নেয় এই ছোট্ট বাক্সের মালিককে খুঁজে বের করবে, হয়তো সে এই বাক্স খুঁজে পেয়ে খুশী হবে। যদিও এমিলি জানে না, বহুদিনের পুরনো, ছেলেবেলায় হারানো জিনিস বড় হয়ে খুঁজে পেলে কি মনোভাব হতে পারে, তবুও আশেপাশের সবাইকে ও জিজ্ঞেস করতে শুরু করে বহু বছর আগে ছোট্ট ছেলে কে ছিল এখানে। বাড়ীর মালিকের মায়ের কাছে গিয়ে জানতে পারে কে ছিল সেই বাড়ীতে – দমিনিক ব্রদুতু নামে এক ছোট্ট ছেলে। প্যারিসে এক নামে প্রচুর মানুষ, তাই এবার প্রতিদিন রেস্টুরেন্ট থেকে ছুটি নিয়ে দমিনিক ব্রদুতুকে খুঁজে বেড়ায় এমিলি। আসল মানুষটিকে খুঁজে পায় না এমিলি।

এমিলি দেখে ওর আশেপাশের অনেকেই একাকী, নীচ তলার ভাড়াটে এক বৃদ্ধ চিত্রকর, যে কিনা কুড়ি বছর ধরে কখনোই বাড়ীর বাইরে যায় নি শুধু Renoir র Luncheon of the Boating Party ছবির নকল এঁকে গেছে, সেও একাকী, একাকী পাশের বাড়ীর ভদ্রমহিলা। সবাই নিজের এক বৃত্তে বাস করছে। তবে সেই চিত্রকর বৃদ্ধ এমিলিকে দমিনিক ব্রদুতুর ঠিকানা দেয়।

বয়স্ক দমিনিক ব্রদুতু প্রতিদিন বাজারে গিয়ে মুরগি কেনেন। কিন্তু, সেদিন তাঁর জীবন প্রতিদিনের ছন্দের বাইরে চলেছিল। দমিনিক ব্রদুতুর চলার পথের পাশে এক টেলিফোন বুথে টেলিফোনের আওয়াজ শুনে তিনি বুথে গিয়ে ছেলেবেলার বাক্স পান, এমিলিই রেখেছিল। বাক্সটি পাওয়ার পর এক ঝটকায় দমিনিক ব্রদুতু ফিরে যান ছেলেবেলায়। এক ছোট্ট বাক্সে তাঁর ছেলেবেলা বন্দী দেখে তিনি আবেগে বিহ্বল হয়ে যান। অনুভব করেন, নিজের গোটা জীবনকে আরেক বাক্স বন্দী করে ফেলার আগে জীবনের কাছের মানুষের সঙ্গে যত মন কষাকষির জট ছাড়িয়ে ফেলতে হবে।

এমিলি হঠাৎ যেন অনুভব করে জীবনের এক আশ্চর্য অদ্ভুত অনুভূতি – অচেনা অজানা মানুষকে সাহায্যের মধ্যে যে আনন্দ এমিলি সেটা অনুভব করে। রাস্তার অন্ধ লোকটিকে রাস্তা পারাপারে সাহায্য করে। পুরো রাস্তায় অন্ধ লোকটিকে বলে যায় প্যারিসের রাস্তার কথা – কোথায় ফুল নিয়ে বসেছে দোকানি, কোথায় ব্রেড তৈরি হচ্ছে, ফলের দোকানে কি কি বিক্রি হচ্ছে – সবই বলে অন্ধ লোকটিকে।

কিন্তু, এমিলি যখন নিজের জীবনকে ফিরে দেখে ভালোবাসার অভাব অনুভব করে, কষ্ট পায়। তাই গোপনে তাঁর আশেপাশের মানুষের ছোট ছোট কষ্ট দূর করতে চেষ্টা করে। এই সিনেমার মিউজিক এতো ভালো – এক সুর মোহ সৃষ্টি করে দেয়।

বাবার বাগানের মূর্তি চুরি করে ফেরার পথে প্যারিস মেট্রোর ফটো বুথের সামনে এক ভদ্রলোককে আবিষ্কার করে। আগেও এমিলি ফটো বুথের সামনে ওকে কিছু খুঁজতে দেখেছিল। সেদিন লোকটার এক এ্যালবাম পেয়ে যায় এমিলি, ছেঁড়া ফটো জুড়ে অচেনা অজানা লোকের পাসপোর্ট সাইজ ফটো দিয়ে তৈরি সেই এ্যালবাম। এমিলি লোকটির নাম জানতে পারে – Nino , এমিলি প্রেমে পড়ে। গল্প এগোয়।
সহজ সরল এমিলির সহজ জীবনের গল্প নিয়ে তৈরি এই সিনেমা পাঁচটা অ্যাকাডেমি পুরষ্কারের জন্যে মনোনীত হয়। বেশ কয়েকটা ইউরোপিয়ান ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড এই সিনেমার দখলে।

কোন কোন সিনেমা দেখলে মন বেশ ভালো হয়ে যায়, অনেকদিন সিনেমাটির রেশ রয়ে যায় মনে, সিনেমার আবহ সঙ্গীত বার বার শুনতে ইচ্ছে করে, এমিলি ঠিক সেই রকমই এক সিনেমা।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Movie time -:). Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s