নভেম্বরের এক শীত সকাল, এখনো পাহাড়ের উপত্যকায় আটকে আছে ভোরের হালকা কুয়াশা, অথচ উজ্জ্বল সোনালি রোদ উঠেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সেই থমকে থাকা কুয়াশাও উবে যাবে সূর্যালোকের ঈষৎ উষ্ণতায়। ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশের নীচে মিদিপিরেনিস পাহাড়ের কোলে ছোট্ট শান্ত এক ফ্রেঞ্চ গ্রামে সকাল কেমন সাজে, দেখতে বেরিয়ে পড়েছিলাম পাহাড়ি পথ ধরে।
ফ্রান্সের আদি গ্রাম গুলো সত্যি খুবই সুন্দর, আর এই গ্রামীণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে ফ্রেঞ্চদের অহংকারের সীমা নেই। যখন আমাদের গ্রাম উঠে যাচ্ছে শহরে, ওরা গ্রামের প্রেমে আরও নিমজ্জিত হচ্ছে, গ্রামের পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এমনকি, ফ্রান্সের সুন্দরতম গ্রাম গুলোকে সংরক্ষণ করা ও চিহ্নিত করার জন্যে 1982 তে ওরা এক সমিতি গঠন করেছে Les Plus Beaux Villages de France ইংরেজিতে, The most beautiful villages of France। এতদিনে দেড়শোর উপর গ্রামকে ওরা beautiful villages of France বলে শনাক্ত করেছে। সেই সুন্দর গ্রামের তালিকার বেশ কয়েকটা গ্রাম তুলুসের খুব কাছেই। তাই, নভেম্বরের কোন এক ছুটির দিনে আমাদের ঝকঝকে পরিষ্কার এক সকাল হয় ফ্রেঞ্চ পাইরেনিসের এক ফ্রেঞ্চ গ্রামে।
গ্রামের চার্চটি এখনো রোমান যুগের চিহ্ন বহন করছে। একমাত্র শীর্ণ পাহাড়ি নদীটি পাথুরে পথে নাচতে নাচতে বয়ে চলেছে। নভেম্বরের সকালে বাতাসে উত্তুরে হাওয়ার তীব্র কামড় অগ্রাহ্য করে পাহাড়ি পাকদণ্ডী ধরে হেঁটে চলেছি। উদ্দ্যেশ্য গ্রামের শেষে পাহাড়ের উপরের উঁচু অংশে পৌঁছনো, যেখান থেকে সম্পূর্ণ উপত্যকাকে দেখা যায়।
শতাব্দী ধরে এই পাইরেনিস উপত্যকায় এই গ্রামের অবস্থান। বর্তমানে যদিও লোকসংখ্যা কমের দিকে, কিন্তু শীত পড়লেই অনেকেই এই সমস্ত গ্রামে শীতের খেলার টানে বেড়াতে আসে, ছুটি কাটাতে আসে। তাই, ছোট্ট এই গ্রামেও দেখি এক টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার।
উপরে পৌঁছে মুগ্ধ হওয়ার মতোই দৃশ্যে থমকে গেলাম। সকালের নরম উজ্জ্বল রোদ লুটিয়ে পড়েছে চরাচরে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গ্রামের বাড়ি গুলোর উপরে এখনো হালকা মেঘের বা কুয়াশার এক আস্তরণ। যেন এক বদ্ধ বাতাস আটকে আছে উপত্যকায়, ধরে রেখেছে মেঘের চাদর। এখনো যেন গ্রামের ঘুম ভাঙ্গে নি, কেমন এক আলস্য জড়ানো পরিবেশে।
মিদি পাইরেনিসের কোন এক পাহাড়ের উপরে বসে নরম রোদের উত্তাপ নিতে নিতে নভেম্বরের তীব্র ঠাণ্ডা সকালেও এক হালকা উষ্ণতা অনুভব করি। বেলা বয়ে যায়। ফিরে আসি। আজও হয়তো, সেই গ্রামে প্রতিটি সকাল হয় মেঘের চাদর জড়িয়ে, সূর্য উঠে এসে সেই চাদর সরিয়ে পাহাড়ি গ্রামটির মুখ দেখে কিংবা ইলশেগুড়ি বৃষ্টি এসে গ্রামটিকে জাগায়, অথবা শীতকালে সারারাতের তুষারপাত গ্রামটিকে সাদা করে রাখে।